যদিও মাথার কাপড়ের বিষয়টি একান্তই মহিলাদের, তবুও আলোচনা শুরু করবো কোনো মহিলার উদাহরণ দিয়ে নয়। প্রথম কেস স্টাডি হিসেবে আমি টানবো ভারতের গান্ধীকে, কারণ তার হাত দিয়েই সম্ভবত আধুনিক রাজনীতিতে মুসলমানদের ত্রাতা সেজে ধোঁকা দেয়ার এই অভিনব কায়দার সূত্রপাত হয়।
গান্ধীর রাজনীতির সূত্রপাত হয় খিলাফত আন্দোলনে যোগদানের দ্বারা। সেই আন্দোলনে গান্ধী প্রথমে মুসলমানদের নিকট নেতা হিসেবে একটি অবস্থান তৈরী করে। এরপর গান্ধী দাবি করে, হিন্দুর অনুভূতিকে মান্যতা দিয়ে মুসলমানদের গরু জবাই ত্যাগ করতে হবে। বলা বাহুল্য, গান্ধীকে নেতা মেনে সেটি মুসলমানরা করলো। এছাড়াও গান্ধীর আন্দোলনের মূল পলিসি ছিল ‘অসহযোগ’, যা দ্বারা ব্রিটিশদের চাকরি-ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করাকে বোঝানো হয়। গান্ধীর কথায় সব মুসলমান তাদের জীবিকা ও শিক্ষার মাধ্যমকে ত্যাগ করলো।
কিন্তু হিন্দুদের সংবাদপত্রগুলো প্রচার শুরু করলো যে, “গান্ধী মুসলমানদের দালাল হয়ে গেলো রে!” বলা বাহুল্য, এই প্রচারের পেছনে একদিকে যেভাবে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব দায়ী ছিল, অন্যদিকে দায়ী ছিল গান্ধীপন্থী মুসলমানদের অতি-উৎফুল্লতা। শরৎচন্দ্রের একটি তীব্র মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ভাষণের কথা অনেকেই শুনেছেন, সেখানে শুরুতেই গান্ধীর কথিত মুসলিম-প্রেম নিয়ে চরম কটাক্ষ করা হয়েছে এই বলে যে, “সেকালে বড় বড় মুসলিম পাণ্ডাদের কেহ-বা হইয়াছিলেন তাঁহার (গান্ধির) দক্ষিণ হস্ত, কেহ-বা বাম হস্ত, কেহ-বা চক্ষু-কর্ণ, কেহ-বা আর কিছু,—হায়রে! এত বড় তামাশার ব্যাপার কি আর কোথাও অনুষ্ঠিত হইয়াছে!” (http://bit.ly/2UX6IYZ)
যাই হোক, গান্ধীর কথায় মুসলমান যখন সর্বস্ব ত্যাগ করলো, তখন গান্ধী সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে চৌরিচৌরা ফাঁড়িতে পুলিশ হত্যার দোহাই দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াল। তখনই মুসলমানরা বাস্তব দুনিয়ায় পদার্পণ করে দেখল যে, তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। গান্ধী তাদেরকে দিয়ে চাকরি-পড়াশোনা ছাড়িয়ে, গরু জবাই ত্যাগ করিয়ে মাঝপথে সটকে পড়েছে। এই বিহবলতার সুযোগ ব্রিটিশরাও আন্দোলনে ব্যাপক ধরপাকড় চালালো, মুসলমানদের তুঙ্গে ওঠা আন্দোলন বানচাল হয়ে গেল। মুসলমানদের ছেড়ে দেয়া চাকরির শূন্যপদগুলোতে ব্রিটিশরা হিন্দুদের নিয়োগ দিলো।
এর পরপরই ভারত জুড়ে সহিংস দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল, যার পটভূমি তৈরী হয়েছিল উগ্র হিন্দুদের দ্বারা ‘গান্ধী মুসলমানদের দালালি করছে, মুসলমান সব নিয়ে যাচ্ছে’ এই প্রচারের মাধ্যমে। সেখানেও মুসলমান পড়ে পড়ে মার খেলো, কারণ মাঝপথে পানিতে ফেলে দেয়ায় তারা ছিল রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
অর্থাৎ বিধর্মী রাজনীতিকদের দ্বারা ত্রাতা সেজে মুসলমানদের সর্বস্বহারা বেকুব বানানোর যে উপরোক্ত রাজনীতি, তার ধাপগুলো নিম্নরূপ-
১) মুসলমানদের নেতা সাজা এবং ব্যাপক সমর্থন লাভ করা
২) মুসলমানদের অতি উৎফুল্লতার সুযোগে বিধর্মীদের মধ্যে প্রচার করা, মুসলমান সব নিয়ে গেলো রে! অতিরঞ্জিত বক্তব্য ও গুজবের দ্বারা চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা।
৩) অথচ মুসলমান আসলে কিছুই পায় না, বরং তলা কেটে তাদেরটাই নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু বিধর্মী নেতার প্রতি অতি আবেগ ও ভালোবাসায় তারা সেটা টেরও পায় না
৪) মুসলমানদের সবকিছু নেওয়া হলে সুযোগ বুঝে মাঝপথে সটকে পড়া
৫) হতবিহবল মুসলমানদেরকে ২য় ধাপে বর্ণিত উত্তেজিত কাফিরদের সহজ শিকারে পরিণত করা
গান্ধীর প্রদর্শিত ঠিক এই রাজনীতিই বর্তমানে করছে মাথায় কাপড় দেওয়া কতিপয় বিধর্মী মহিলা, তথা পশ্চিমবঙ্গের মমতা, জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এবং সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডা। পশ্চিমবঙ্গের মমতা স্রেফ মাথায় কাপড় দিয়ে সেখানকার মুসলমানদের নেতা সেজেছিল, মুসলমানরাও তার প্রতি প্রচুর আবেগ দেখিয়েছিল। যদিও বাস্তবতা হলো, মমতার আমলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের চাকরিতে পার্সেন্টেজ আগের তুলনায় কমেছে। এছাড়াও মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অথচ সেই মমতার মাথায় কাপড় দেওয়া ছবি নিয়ে হিন্দুরা প্রচার করেছে, মুসলমান আমাদের সবকিছু নিয়ে গেলো গো! (এ নিয়ে একটি মজার ভিডিও দেখতে পারেনঃ https://youtu.be/vBSekeNLPts) সেই প্রচারের কারণে এখন মুসলমানদের আদতে কিছু দেওয়া তো দূরে, বরং বঞ্চিত করা হলেও পশ্চিমবঙ্গে প্রায়শ উগ্র হিন্দুদের দ্বারা দাঙ্গা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এক ইমামের ছেলের বুকের কলিজা চিড়ে নেওয়া হয়েছিল কিছুদিন আগে, মনে পড়ে?
অ্যাঙ্গেলা মার্কেল যখন ইউরোপে সিরিয়ার মুসলমান শরণার্থীদের আহবান করে, তখন তা নিয়ে নিয়ে প্রবল সাম্প্রদায়িক প্রচারণা শুরু হয় এই বলে যে, মুসলমান ইউরোপ দখল করে নিলো রে! কিন্তু বাস্তবতা হলো, জার্মানিতে ঢোকার সাথে সাথেই শরণার্থীদের মূল্যবান জিনিসপত্র, টাকা পয়সা জার্মান পুলিশ কেড়ে নেয়। (https://p.dw.com/p/1HiCg)
তারপরও ইউরোপের টিভি চ্যানেলগুলোতে মার্কেলের মাথায় ফটোশপ করা হিজাব পড়িয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালানো হয়। বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয় যে, শরণার্থীরা খ্রিস্টান মেয়েদের ধর্ষণ করছে ইত্যাদি। এর জের ধরে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল পুড়িয়ে দেয়া হয়, ইউরোপের তীব্র শীতে বরফে জমে তাদেরকে মরতে দেয়া হয়। তাদের নারী ও শিশুদের ধরে ধরে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় বাধ্য করা হয় শুকরের গোশত ভক্ষণ করতে। অনেককে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
এখন ইউরোপে মুসলিম শরণার্থীদের ন্যায় ওশেনিয়া তথা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মুসলমানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে, শুকরের গোশত খাওয়াতে, তাদের মেয়েদের পতিতালয়ে বিক্রি করার প্রেক্ষাপট তৈরী করতেই জেসিন্ডা মাথায় কাপড় দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই প্রেক্ষাপট মুসলমানরাই তৈরী করছে জেসিন্ডার প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখিয়ে দেখিয়ে। মমতা-মার্কেলের ন্যায় জেসিন্ডার এই মাথায় কাপড় দেয়া ছবি প্রচার করে, মুসলমানদের অতি-উৎফুল্লতার বিষয়টি ফোকাস করে ইউরোপের ন্যায় ওশেনিয়া অঞ্চলে উগ্র খ্রিস্টানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পাঠকেরা নোট করে রাখুন, অচিরেই উক্ত অঞ্চলের মিডিয়ায় ব্যাপক মুসলিমবিরোধী প্রচার শুরু হবে এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি হবে উক্ত অঞ্চলে মুসলিম গণহত্যা।
হাদীছ শরীফে রয়েছে, মু’মিন কখনো এক গর্তে দুবার পড়ে না। বর্তমান মুসলমানরা মমতা-মার্কেলের গর্তের পর এখন জেসিন্ডার গর্তে পড়তে যাচ্ছে, কারণ তাদের মধ্যে ঈমানী দৃঢ়তা নেই। যে কারণে তাদের ৫০ জনের ভাইয়ের মৃত্যুর পর জেসিন্ডার মাথার কাপড়ই তাদেরকে রীতিমতো তরল করে দিয়েছে। গত কয়েকদিনে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ক্রুসেডীয় আনজাক চেতনা নিয়ে লিখে প্রচুর গালি শুনতে হয়েছে, না তারা কিছুতেই মানবে না। তারা ফের গর্তে পড়বেই পড়বে, সত্যিকার মু’মিন হওয়ার আগপর্যন্ত এই আত্মঘাতী পথ থেকে তারা নিস্তার পাবে না।
Post a Comment