Image may contain: 1 person, closeup and indoor

আমার কাশ্মীর নিয়ে পূর্ববর্তী পোস্টগুলোতে একটি মন্তব্য করেছি যে, ব্রিটিশ আমলের প্রেক্ষিতে বাংলা ও কাশ্মীরের মুসলমানদের ইতিহাসের মিল খাপে খাপ। ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলাকে যেমন হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি দেয়া হয়েছিল কাশ্মীরকে। বাংলায় হিন্দুরা যেমন ক্ষমতা পেয়েই মুসলমান নির্যাতন শুরু করেছিল, কাশ্মীরে তা ছিল আরো বেশি ভয়ানক। কারণ বাংলায় হিন্দুরা মুসলমান নির্যাতন করত ব্রিটিশদের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারী লাভ করে, সরাসরি শাসক তারা ছিল না। বিপরীতে কাশ্মীর ছিল ‘প্রিন্সলি স্টেট’ হিসেবে সরাসরি ব্রিটিশ নিয়োজিত হিন্দু রাজার অধীন। কাশ্মীরের হিন্দু শাসকেরা সরাসরি সৈন্য ব্যবহার করে ব্যাপকহারে মুসলিম গণহত্যা চালিয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। বাংলায় হিন্দু জমিদাররা পেয়াদা-লাঠিয়াল দিয়ে মুসলিম নির্যাতন করলেও, সরাসরি সৈন্যবাহিনী তাদের ছিল না।

ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগ ‘ইস্টিশন’ একটি ভিডিও বানিয়েছিল ভারতে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে, যার ম্যাক্সিমামই হচ্ছে কাশ্মীরে ব্রিটিশ নিয়োজিত রাজা গুলাব সিং ও তার পুত্র রণবীর সিংয়ের মুসলিম গণহত্যা নিয়ে। (
https://www.facebook.com/istishon/videos/476856486452095/)

বাংলায় মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃপ্ত কণ্ঠস্বর হিসেবে উঠে এসেছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, যার নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের কোয়ালিশন করে বাংলার মুসলমানরা সর্বপ্রথম বেঙ্গল প্রভিন্সে ক্ষমতায় আরোহন করেছিল। শেরে বাংলা শুধু বাংলার মুসলমানদের ক্ষমতাই দেননি, তিনি লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাবও রেখেছিলেন। মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির সমন্বয়ে শেরে বাংলার নেতৃত্বে বাংলার মাটি ভবিষ্যতের পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূতিকাগার হয়ে উঠে।

কিন্তু এই শেরে বাংলা-ই একপর্যায়ে বিগড়ে যান, মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন ভেঙে দিয়ে কট্টর হিন্দু শ্যামাপ্রসাদের ‘হিন্দু মহাসভা’ দলের সাথে কৃষক-প্রজা পার্টির কোয়ালিশন করেন তিনি। এই শ্যামাপ্রসাদকে নিশ্চয়ই পাঠকেরা অনেকেই চেনে, ভারতের বিজেপি দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সে। শেরে বাংলা এই শ্যামাপ্রসাদকে সাথে নিয়েছিল তার শিক্ষক আশুতোষের ছেলে হিসেবে, যদিও সে সবসময়ই ছিল কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী।

আসলে উপমহাদেশের মুসলমানদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ‘সব হিন্দু খারাপ নয়’, এটাই যতো নষ্টের গোড়া। এদেশের মুসলমানরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশী, কলিগ, স্যারের ছেলে অমুক-তমুক সুতা টেনে হিন্দুদের চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকে, যেমনটি দিয়েছিল একে ফজলুল হক। একারণে চট্টগ্রামে হিন্দুরা মুসলমান বাচ্চাদের প্রসাদ খাওয়ালেও সেখানকার স্থানীয় মুসলমানেরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে কিছু্ই করতে পারেনি, বা করতেও চায়নি।

কিন্তু শেরে বাংলা বিগড়ালে কি হবে, বাংলার শিক্ষিত মুসলমান যুবকরা তীরে এসে তরী ডুবাতে রাজি ছিল না। তারা মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে ‘শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা’র বিরুদ্ধে। শ্যামাপ্রসাদের সাথে জোট করার এক বছরের মাথায় ১৯৪২ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। শুধু তাই-ই নয় পরবর্তী ১০ বছর, তথা ব্রিটিশ আমল শেষ হয়ে পাকিস্তান আমলে গিয়ে ১৯৫৩ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগপর্যন্ত এই শেরে বাংলাকে বাংলার রাজনীতিতেই নিষ্ক্রিয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকতে হয়!

অর্থাৎ এতোবড় জাঁদরেল নেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে সাময়িক হাইবারনেশনে পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাদের বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষেরা, শ্যামাপ্রসাদের ন্যায় কট্টর হিন্দুর সাথে জোট করার অপরাধে। শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতেও এর উল্লেখ রয়েছে, যিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে।

এখন শেরে বাংলার মতো ‘শেরে কাশ্মীর’ নামেও একজন ছিল, সে হচ্ছে নেহরুর সহযোগী বিশ্বাসঘাতক শেখ আব্দুল্লাহ। পার্থক্য হচ্ছে, এই শেরে বাংলা যখন বিগড়ে গিয়ে হিন্দুর হাত ধরেছিল, তখন বাংলার মুসলিম জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে নামতে বাধ্য করেছিল। বাংলার মুসলমানরা আদর্শের উর্ধ্বে নেতাকে স্থান দেয়নি, ব্যক্তিপূজায় লিপ্ত হয়নি। বিপরীতে এই শেখ আব্দুল্লাহ যখন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ প্রেমনাথ বাজাজের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে নেহরুর সাথে দোস্তি করল, নিজের ‘মুসলিম কনফারেন্স’ দলটির নাম পাল্টে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ করল হিন্দুদের তুষ্ট করার লক্ষ্যে, তখন কিন্তু কাশ্মীরের মুসলমানরা প্রতিবাদ করেনি। তারা বরঞ্চ ব্যক্তিপূজাকে প্রাধান্য দিল, নেতার অনুকরণে নিজেরাও সেক্যুলাঙ্গারে পরিণত হল। জম্মুর মুসলমানদের উপর সাতচল্লিশে সংঘটিত গণহত্যায় কাশ্মীরে বসবাসরত মুসলমানরা মৌন সমর্থন দিল, কারণ জম্মুর মুসলমানরা ভারত নয় পাকিস্তানের সাথে কাশ্মীরের অন্তর্ভূক্তি চেয়েছিল।

মোটামুটি হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে কাশ্মীরের সাথে বাংলার মুসলমানদের সব জায়গাতেই মিল আছে, শুধুমাত্র এই একটি জায়গা বাদে। এখানে মিল থাকলে কাশ্মীরিরা আজ ভারতে গরু-ছাগলের মতো না থেকে সম্মানের সাথে মুসলিম-শাসিত ভূখণ্ডে বসবাস করতে পারত।

শেরে বাংলা ও শেরে কাশ্মীরের মধ্যে হিন্দুর সাথে জোট বাধা প্রসঙ্গে মিল তো আলোচিত হয়েছেই, নেহরুকে কেন্দ্র করেও তাদের মধ্যে মিল রয়েছে। শেখ আব্দুল্লাহর আলোচনা করতে গেলে নেহরুর প্রসঙ্গ আসবেই, কারণ নেহরুর চামচামি করেই সে কাশ্মীরকে ভারতের করদরাজ্য করেছে। শেরে বাংলা অবশ্য নেহরুর চামচা ছিল না, বরং নেহরুই ছিল ১৯১৮-১৯ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলার ‘পিএস’ (উইকিপিডিয়াতে ছবিসহ রয়েছে)! এই নেহরু সারাজীবন শেরে বাংলা, আবুল কালাম আজাদের মতো মুসলিম নেতাদের নবিশি করে রাজনীতি শিখেছিল। অবশ্য সমস্ত মুসলিমবিদ্বেষী প্রতিষ্ঠিত হিন্দু নেতা, হোক সে নেহরু বা শ্যামাপ্রসাদ, তাদের সবার গর্দানেই মুসলমানদের জমানো চর্বি পরিলক্ষিত হয়।


Post a Comment

 
Top