দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের অব্যহত ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তি ও গালিগালাজের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের কিছু কমন কমেন্ট প্রায়ই চোখে পড়ে। খালি একটা বছর যাক, খালি আওয়ামী সরকারটা সরুক, তাহলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এমন একটি ভাব সবাই নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হিন্দুদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতবর্ষের তাবৎ মুসলমানদের বেসিক মনোজাগতিক সমস্যা। আওয়ামী লীগ এখানে কোন ফ্যাক্টর নয়।

ভারতীয় মুসলমানদের দুইটি গ্রুপ, বড় গ্রুপটি অখণ্ড ভারতে হিন্দুদের সাথে থাকতে চেয়েছিল। আর ক্ষুদ্র গ্রুপটি বলেছিল, পাকিস্তান না হলে মুসলমানদের অধিকারের বালাই থাকবে না। হয়তো অনেকের ধারণা হতে পারে, একদল বোধহয় হিন্দুপ্রেমিক, আরেকদল হিন্দুবিদ্বেষী। ধারণাটি ভুল, বরং দুই দলই ছিল বেসিকালি কংগ্রেসের অনুসারী, দুই দলের গোড়াই হিন্দুপ্রীতিতে নিহিত। কংগ্রেসের অনুসারী বৃহৎ অংশটি হিন্দুদের পাছামারা খেতে অভ্যস্ত ছিল এবং প্রত্যেক পরিস্থিতিতে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই স্লোগান দিত, যারা বর্তমানে ভারতীয় মুসলমান হিসেবে পরিচিত। এই একবিংশ শতাব্দীতেও এই জনগোষ্ঠীটি পাছামারা খেয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, তবুও হিন্দুপ্রীতি কমার কোন লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই।

কিন্তু একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল, যারা হিন্দুপ্রেমিক হয়েও বুঝতে পেরেছিল তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্যে হিন্দুপ্রীতি আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা বিদ্রোহ করল নিজ দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, মুসলিম লীগকে ‘জীবিত’ করে পাকিস্তান ছিনিয়ে আনল। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এই দলটি মূলত গঠিত হয়েছিল বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে।

মুসলিম লীগের এই ‘জীবিত’ হওয়ার বিষয়টি ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়। মুসলিম লীগের আনুষ্ঠানিক জন্ম ১৯০৬ সালে হলেও তখনও রাজনৈতিক দল হিসেবে তার প্রাণ সঞ্চারিত হয়নি। ১৯৩০ এর দশকে চিত্তরঞ্জনের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল, নেহরু রিপোর্টে মুসলমানদের অস্তিত্ব অস্বীকার, গান্ধীর সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব এসবের কারণে কংগ্রেসের মুসলিম নেতাকর্মীদের একটি অংশ মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে দলটির মূল নেতৃত্ব গ্রহণ করে। কংগ্রেসের এসব মুসলমান নেতাকর্মী ছিল আগে থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়, ফলে এদের যোগদানের সাথে সাথে মুসলিম লীগের সক্রিয় রাজনৈতিক ধারার সূত্রপাত হয় এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগ ফের ‘জীবিত’ হয়।

এরাই পরবর্তীতে পাকিস্তান ছিনিয়ে আনল। কিন্তু পাকিস্তান হলেই বা কি হবে, এরা তো গোড়াতেই হিন্দুপ্রেমিক। যার ফলে যখন পাকিস্তান অর্জিত হয়েই গেল, কংগ্রেসের সাথে ঝগড়ার অধ্যায়ও শেষ হলো, তখন এই মুসলিম লীগারদের মনে পুরনো হিন্দুপ্রেম ফের বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উছলে উঠল! এরাই পরবর্তীতে রবীন্দ্রচেতনার মূল ভয়েসে রূপান্তরিত হলো। এদেরই একটি বড় অংশ পরবর্তীতে হিন্দুস্তানের একনিষ্ঠ দালালে পরিণত হলো।

এটাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ গোড়ায় অপারেশন না করলে কেবল ব্যান্ডেজপট্টি দিয়ে রোগ সারানো সম্ভব নয়। সাতচল্লিশে ভারতকে দূরে হটিয়েও যেমন মূল সমাধান হয়নি, ঠিক এখন আওয়ামী লীগকে হটিয়েও চূড়ান্ত সমাধান হবে না, যদি মুসলমান তার হিন্দুপ্রীতি ত্যাগ না করে।

একটি সহজ উদাহরণ দেই, তা হলো প্রত্যেকবার সরকার পাল্টানোর সময়ে ভার্সিটি হলগুলো থেকে পুরাতন সরকারের অনুসারীদের হটিয়ে নতুন সরকারের ক্যাডাররা দখলে নেয়। কারণ পুরাতন সরকারের সময়ে তারা যে হুলিয়া মাথায় করে বেড়িয়েছে, সেটা তারা ভুলতে পারে না। এখন চিন্তা করুন রংপুর, নাসিরনগরের কথা। এক বছর আগে নাসিরনগরের মুসলমানদেরকে হিন্দুদের চক্রান্তের শিকার হয়ে কনকনে শীতের রাতে ক্ষেতের মধ্যে রাত কাটাতে হয়েছে। কিন্তু সরকার তো চিরকাল সেখানে পুলিশ-আর্মি দিয়ে মুসলমান খেদিয়ে বেড়ায়নি, বড়জোর একমাস পরেই সরকার তার কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, মুসলমানরাও যার যার বাড়িতে ফেরত এসেছে। এরপর কি তারা ঐসব মিথ্যাবাদী হিন্দুদের উপর নূন্যতম প্রতিশোধও নিয়েছে, যেমনটি ভার্সিটি হলগুলোতে নেয়া হয়? প্রশ্নই উঠে না, বরং কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা সবকিছু ভুলে গিয়েছে, টি স্টল থেকে শুরু করে সব জায়গায় হিন্দুদের সাথে গলাগলি শুরু করে দিয়েছে। যেভাবে পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগাররা হিন্দুদের সব অত্যাচার-নির্যাতন ভুলে হিন্দুপ্রীতিতে উছলে উঠেছিল, ঠিক সেরকম।

রংপুরের ঘটনাও সেম। সরকারি বাহিনী চিরকাল রংপুরে থাকবে না। কিছুদিন পরই মিডিয়ার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হলে পুলিশও তাদের কার্যক্রম সেখান থেকে গুটিয়ে নিবে। রংপুরের মুসলমানরা ফের তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে, আর যেতে না যেতেই হিন্দুদের সাথে ফের পুরনো দিনের মতো গলাগলিতে মশগুল হয়ে পড়বে। মুসলমানরা ভুলেই যাবে যে, এই হিন্দুরাই পুলিশের সাথে মিলে তাদের ৬ জনকে হত্যা করেছে ইসলাম অবমাননার বিচার চাওয়ার জন্য।

এসব কারণে আওয়ামী লীগ গেলেই সবকিছু উল্টে দেব, হ্যান করব ত্যান করব, এরকম আস্ফালন আমার কাছে নিতান্তই হাস্যকর শোনায়। বরং বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ গেলেই তোমরা মুসলমানরা সবকিছু ভুলে যাবে। হিন্দুদের সমস্ত অন্যায়, মুসলিম ছাত্রী ধর্ষণের উৎসব, ইসলাম অবমাননা সব কালের গহবরে চাপা পড়ে যাবে আর হিন্দুরাও ফের ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যাবে।

Post a Comment

 
Top