হিন্দুদের নিজস্ব ইতিহাস নেই, তাই হিংসাবশত মুসলমানদের ইতিহাস বিকৃত করেই হিন্দুদের আনন্দ। ইতিহাসে দিল্লীর বাদশাহ আলাউদ্দীন খিলজী কর্তৃক রাজস্থানের চিতোর রাজ্য অবরোধের উল্লেখ রয়েছে, আর এই ইতিহাসকে বিকৃত করেই ‘পদ্মাবতী’ নামক কল্পকাহিনীর জন্ম। হিন্দুরা দাবি করে থাকে, চিতোর অবরোধের মূল লক্ষ্য ছিল ‘পদ্মাবতী’ নামক এক হিন্দু রাণিকে নিজ আয়ত্ত্বে নিয়ে আসা। অথচ ইতিহাসের পাতায় ‘পদ্মাবতী’ নামক কোন চরিত্রের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই।

‘পদ্মাবতী’ কাহিনীটি যে কাল্পনিক, তা নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে একাডেমিক পর্যায়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগোর ‘রাজস্থান কাহিনী’ বইয়ে একটি আলাদা অধ্যায়ই রয়েছে ‘পদ্মাবত কাব্য ও পদ্মিনীর অনৈতিহাসিকতা’ নামে । তাতে উল্লেখ করা হয়েছে-

১) প্রসিদ্ধ কবি ও ঐতিহাসিক আমীর খসরু চিতোর অবরোধের সময় আলাউদ্দীনের সঙ্গে বরাবর ছিলেন। তিনি রত্নসেন, পদ্মিনী, গোরা, বাদল কারো নাম শোনেন নাই। স্ত্রীলোক সংক্রান্ত কোন ব্যাপার নিয়ে যে এই যুদ্ধ হয়েছিল, তাও তিনি লেখেন নাই।

২) ফিরিশতার ইতিহাস রচনার ২৫০ বছর পূর্বে জিয়াউদ্দীন বারানী ‘তারিখ ই ফিরোজশাহী’ লিখেছিলেন। তিনি আলাউদ্দীনের প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দাই বেশি করেছেন। কিন্তু চিতোর বিজয় সম্পর্কে আমীর খসরুর চেয়ে বেশি কিছু বলেন নাই। এতেও পদ্মিনী উপাখ্যানের নামগন্ধ নাই।

দিল্লির প্রতাপশালী বাদশাহর কি মেয়ের অভাব পড়েছিল যে, চিতোরের মতো অখ্যাত গ্রামে এসে হিন্দু মহিলার খোঁজ করতে হবে? এই ‘পদ্মাবতী’ নামক কাহিনীর মূল উৎস কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দিতে রচিত ‘পদ্মাবত’ কাব্য, যেখান থেকে কবি ‘আলাওল’ রচনা করেন বাংলা ‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি। মালিক মুহম্মদ জায়সী তার ‘পদ্মাবত’ কাব্যের উপসংহারে যা উল্লেখ করেছিলেন, তা কালিকারঞ্জন কানুনগো তার বইতে এভাবে উল্লেখ করেছেন যে-

//পাছে লোকে তাহার কাব্যকে ইতিহাস বলে ভ্রম করে সেজন্য তিনি উপসংহারে স্পষ্টই বলে গিয়েছেন “পদ্মাবত” একটি allegorical poem বা রূপক কাব্য। রতনসেন মন স্বরূপ-আমাদের দেহরূপী চিতোরের রাজা। সে মেবার রাজ সমরসিংহের পুত্র নয়। হৃদয় রূপ সিংহল দ্বীপে বুদ্ধি রূপা পদ্মিনীর উদ্ভব হয়েছিল। ইতিহাসে পদ্মিনী রাণীকে খোঁজা বৃথা।//

উল্লেখ্য, ভারতে যেই রামমন্দির নিয়ে হিন্দুরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, সেই রাম নামক চরিত্রটির জনক বাল্মিকীও তার রামায়ণ কাব্যের শুরুতেই বলে গিয়েছিল যে, রামের জন্ম কবির হৃদয়ভূমিতে, অর্থাৎ ‘রাম’ চরিত্রটিই কাল্পনিক। ‘পদ্মাবতী’ও সেরকমই একটি কাল্পনিক চরিত্র, যেভাবে মিসির আলী কিংবা হিমু কাল্পনিক চরিত্র। আশ্চর্যের বিষয়, এই পদ্মাবতী কাব্যের মূল রচয়িতা জায়সী ও অনুবাদক আলাওল, দুজনই মুসলমান। ব্রিটিশ আমলে এই ‘পদ্মাবতী’ কাহিনীকে নতুন করে এন্টি ইসলামিক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়, যা জায়সী কিংবা আলাওলের কাব্যে ছিল না। জায়সী স্পষ্ট করে বলেই গিয়েছেন এটি কাল্পনিক চরিত্র, অথচ তা নিয়ে এখন হিন্দুরা গোটা ভারতে জ্বালাও-পোড়াও করছে। যা মূলত হিন্দুদেরকে জাতিগতভাবে অশিক্ষিত বলেই সাব্যস্ত করে।

তাই পদ্মাবতী মূলত উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুখ, ইতিহাসের চরিত্র নয় এটি। বানসালি কর্তৃক দীপিকা পাড়ুকোনকে দিয়ে ‘পদ্মাবতী’ নামক সিনেমাটিও মূলত এন্টি ইসলামিক সিনেমা, সিনেমার ট্রেলারে ‍মুসলমান শাসক আলাউদ্দীন খিলজীকে অত্যন্ত নোংরাভাবে উপস্থাপন করেছে এই বানসালি। তাই এই সিনেমা নিয়ে মূলত প্রতিবাদ করার কথা ছিল ভারতের মুসলমানদের, হিন্দুদের নয়। কিন্তু আফসোসের বিষয়, ভারতীয় মুসলমানরা অনেক আগে থেকেই হিন্দুদের সাথে মিশতে মিশতে নিজেদের অস্তিত্বকে বিলীন করে হিন্দুদের গোলামে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাই প্রতিবেশী হিন্দুরা মুসলিম বাদশাহকে অপমান করলে, পূর্বপুরুষের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করলে ভারতীয় মুসলমানদের গায়ে এখন আর লাগে না।

(রাজস্থান কাহিনী বইটির লিঙ্ক কমেন্টে দেয়া হয়েছে)

Post a Comment

 
Top