(১)

কিছুদিন পূর্বে সরকার যখন রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করে, তখন তাতে হিন্দুদের নাম থাকায় হিন্দুরা তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক তখন বিবৃতি দেয় যে, এই তালিকা তারা বানায়নি। তৎকালীন পাকিস্তানী প্রশাসন রাজাকার তাদের সহযোগীদের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিল, সেটাকেই অবিকৃত অবস্থায় তারা প্রকাশ করেছে।

তারপরও হিন্দুদের তীব্র বিরোধিতায় সরকার সেই তালিকা ফিরিয়ে নেয় এবং তার দ্বারা এটাই মূলত সাব্যস্ত করা হলো যে, হিন্দুরা নির্দোষ এবং এদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার দায় একান্তই মুসলমানদের! অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে সোভিয়েত-ভারতের সংশ্লিষ্টতা, বিপরীতে পাকিস্তানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে পিকিংপন্থী (তৎকালীন চীনের রাজধানী পিকিংয়ের নামানুসারে) কমিউনিস্ট সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছিলদুই কুকুরের লড়াইবলে। এম আর আখতার মুকুল তারআমি বিজয় দেখেছিগ্রন্থে প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছে- “পিকিংপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) তৃতীয় উপদল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করল। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে এদের নেতৃত্ব  দান করে কমরেড আবদুল হক, সত্যেন মিত্র, বিমল বিশ্বাস জীবন মুর্খজি প্রমুখ। এতদঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিকিংপন্থী হক গ্রুপের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রচুর হিন্দু ছিল এবং এরা স্বাধীনতা যুদ্ধে তো বটেই, দেশ স্বাধীনের পরও তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বোমাবাজি করেছে। নানাবিধ সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে জাসদ একধরণের বোমা ব্যবহার করত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, যার নাম ছিলনিখিল বোমা তাদেরনিখিল সাহানামক এক কর্মী এই বোমা বানাতে গিয়ে নিহত হয়, একারণে বোমাটির নামই তার নামে নামকরণ করে এই কুখ্যাতজাসদ

উল্লেখ্য, এসব পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট হিন্দুদের নামই ছিল তৎকালীন পাকিস্তান প্রশাসনের নির্মিত তালিকায়। সুতরাং এদেশে যে ঢালাওভাবে হিন্দুদেরকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের গোষ্ঠী বলে প্রচার করা হয়, তা মোটেই সঠিক নয়। তাই যখন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলের অবিকৃত রাজাকার তালিকাটি প্রকাশ করেছে, তখন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট হিন্দুদের দ্বারা পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ায় তা ধামাচাপা দিতেই হিন্দুরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। হিন্দুরা মূলত দ্বীন ইসলামকে হেয় করতে চেয়েছে, বোঝাতে চেয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাই দেশদ্রোহী আর হিন্দুরা নিষ্পাপ! আওয়ামী লীগও হিন্দুদের মন রক্ষার্থে সেই তালিকাটি বাতিল করে মূলত হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষী দাবিটিকেই মান্যতা দিয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে।

 বিগত ১০ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক-মিডিয়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অছাম্প্রদায়িক টোটকা প্রয়োগ করতে করতে এদেশের মুসলমানদের অনুভূতিহীন মরা গোশতে পরিণত করেছে বর্তমান সরকার। যে কারণে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে লাঞ্ছিত করার পরও এদেশের মুসলমানরা কোনো প্রতিবাদ করেনি।

(২)

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বর্তমানে কতিপয় কথিত চেতনার ফেরিওয়ালা রয়েছে, যারা কথায় কথায় ইসলামী অনুষঙ্গকে তাদের কথিত স্বাধীনতার চেতনার বিরোধী বলে মন্তব্য করে। যদিও তাদের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, বরং পাকিস্তানী ক্যাম্পে মুরগী সরবরাহকারী হিসেবে তাদের নাম উঠে আসে।

এদের পরিচয় হলো, এরা পিকিংপন্থী। মুরগী কবির মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি, বরং দেশ স্বাধীনের পর পিকিংপন্থী সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় সে একের পর এক আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে গিয়েছে। যার অবধারিত পরিণতি ছিল শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যা। এই মুরগী কবির এবং তার চাচাতো ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার, এরা সকলেই ছিল পিকিংপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। স্বাভাবিক ভাবেই চীন তখন পাকিস্তানের বন্ধু হওয়ায় এরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান তো দূরে, বরং হানাদার বাহিনীর সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছিল। মুরগী সরবরাহকারীর ভূমিকা পালন করেছিল।

এই পিকিংপন্থীদের ইতিহাস হলো, এরা পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠীর লেজুড় হিসেবে কাজ করেছে। উল্লেখ্য, সোভিয়েত শাসক স্তালিনের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী হয় ক্রুশ্চেভ, অতঃপর ব্রেজনেভ। এরা কমিউনিস্ট মতাদর্শের নানারকম সংস্কার করে সোভিয়েত রাশিয়ায় তা জারি করে। চীনের মাও সেতুং এর তীব্র বিরোধিতা করে বলে, সোভিয়েত রাশিয়া লেনিন মার্ক্সের মূল আদর্শ থেকে সরে গিয়েছে। চীন রাশিয়ার এই দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ভেঙে যায়। চীন তথা পিকিংপন্থী দলগুলো নিজেদেরকে মার্ক্স-লেনিনের মূল মতবাদের ধারক বলে দাবি করে এবং তাদের নামের শেষেমার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীবা সংক্ষেপে এম.এল. লিখতে শুরু করে। বিপরীতে সোভিয়েতপন্থী দলগুলোকে সম্বোধন করা হতে থাকেরিভিশনিস্টবা সংস্কারপন্থী হিসেবে। অর্থাৎ সোজা ভাষায়, চীনপন্থী দলগুলো হচ্ছে আদতেমৌলবাদীকমিউনিস্ট।

বিপরীতে ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভের সংস্কার প্রস্তাব অনুসারে কমিউনিস্ট দলগুলো বুর্জোয়াদের সাথে কোয়ালিশন করতে পারে, সে জন্য রুশপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলো ভারতে কংগ্রেসের সাথে এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাথে একপ্রকার মিশে যায়।বাকশালগঠনের সময়ে মূলত সিপিবি ন্যাপ মোজাফফর, তৎকালীন দুটো সোভিয়েতপন্থী দল নিজ পরিচয় বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগের সাথে মিশে গিয়েছিল।

পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যেন্যাপনামক দলটি ভেঙে পিকিংপন্থীরা ভাসানীর নেতৃত্বেভাসানী ন্যাপএবং মস্কোপন্থীরা কমরেড মোজাফফরের নেতৃত্বেমোজাফফর ন্যাপেযোগ দেয়। পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন চীনপন্থী তথাভাসানী ন্যাপগ্রহণ করেডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুবনীতি। শুধু তাই নয়, এই ভাসানী ন্যাপ কর্তৃক দফার বিরোধিতা করা হয়। যেই সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছিল, সেই নির্বাচন এই ভাসানী ন্যাপ কর্তৃক বর্জন করা হয়।

 এরপর মুক্তিযুদ্ধকালে এই চীনপন্থী দলগুলোর বড় অংশ গ্রহণ করেদুই কুকুরের লড়াইনীতি। এর অর্থ, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক পুঁজিবাদী বনাম পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল পুঁজিবাদী তথা আওয়ামী লীগের লড়াই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এরা হয় চীনের হুকুম অনুযায়ী অন্ধের ন্যায় পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, নতুবা দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব স্বীকার করলেও মুক্তি সংগ্রামকে ভারতীয় আগ্রাসন বিবেচনায় দুই ফ্রন্টে লড়াই করে!

(৩)

মুক্তিযুদ্ধে এসব চীনপন্থী কমিউনিস্টদের অপকর্ম প্রসঙ্গে এম আর আখতার মুকুল উল্লেখ করেছেন-

ষাট দশকের শেষার্ধে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হয় মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী কমরেড সিরাজ শিকদার। এর নেতৃত্বে ঢাকায় একটিমাও সে তুংগবেষণা কেন্দ্র খোলা হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজ শিকদারের পার্টি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। বরিশালের পেয়ারাবাগানে ধরণের একটা রক্তাক্ত সংঘর্ষও হয়েছে। আবার এরা একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। কেননা এদের বিশ্বাস ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল এটাই হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মফস্বল অঞ্চলে এরা কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়ে জনমনে বিশেষ করে অবস্থাপন্নদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল।

এদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কমরেড তোয়াহার নেতৃত্বে গঠিত পিকিংপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) আবার দ্বিধাবিভক্ত হলো। নোয়াখালী এলাকায় কমরেড তোয়াহার নেতৃত্বে একটি উপদল মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হিসেবে ঘোষণা করল। তবে একই সঙ্গে এরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের তীব্র বিরোধিতার কথা বলল। এদের বক্তব্য ছিলভারতীয় সহযোগিতার বইরে এবং ভারতের মাটিতে না গিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।অন্যথায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার অছিলায় ফায়দা হাছিল করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) আর একটা উপদল কলকাতায়বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিতে যোগ দিল।

পিকিংপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) তৃতীয় উপদল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানেভারতীয় আগ্রাসনবলে আখ্যায়িত করল। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে এদের নেতৃত্ব দান করে কমরেড আবদুল হক, সত্যেন মিত্র, বিমল বিশ্বাস জীবন মুর্খজি প্রমুখ। এতদঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিকিংপন্থী হক গ্রুপের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের মধ্যে নীতির প্রশ্নে বিভ্রান্তি অব্যাহত থাকে। কমরেড হকের নেতৃত্বে একটি উপদল স্বাধীনতার পরেও কিছুদিন পর্যন্ত যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। কেননা পাকিস্তানের পাশাপাশি চীন তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করেনি এবং বাংলাদেশকেঢাকা প্রশাসনবলে আখ্যায়িত করছিল।

 পিকিংপন্থীদের কেউ কেউ বাংলাদেশের অস্তিত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করে। হক গ্রুপের নেতৃত্বে এদের বিশ্বাস ছিল যেভারত এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে। সুতরাংপূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল)’ নাম পরিবর্তনের (তথা পার্টির নাম হতেপূর্ব পাকিস্তানবাদ দেয়ার) প্রশ্নই উঠতে পারে না। উপরন্তু একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তাহলেই ভারতীয় আধিপত্যবাদের অবসান হবে।

নয়া পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের কমরেড তোয়াহা, সুখেন্দু দস্তিদার, বিমল দত্ত পার্টির নাম পরিবর্তন করল। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এর নতুন নামকরণ হলকমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) পূর্ব বাংলা ১৯৭৩ সালে পার্টি কংগ্রেসে এরা আবার দলের নয়া নাম দিলপূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (উল্লেখ্য, এই সাম্যবাদী দল থেকেই ২০০৯- আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল দিলীপ বড়য়াকে) এদের বক্তব্য হচ্ছেষোলই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের উপনিবেশ কায়েম হয়েছে মাত্র। মুজিব সরকার সোভিয়েত রাশিয়ার পুতুল সরকার।” (আমি বিজয় দেখেছি, এমআর আখতার মুকুল, পৃষ্ঠা ৩৬৪-৩৬৫)

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে রাজাকার এবং স্বাধীনতাবিরোধী শ্রেণী বলতে ঢালাওভাবে তৎকালীন ইসলামী মনোভাবাপন্নদের তুলে ধরা হচ্ছে, যদিও পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষাবলম্বনের ইতিহাস ঘাটলে উঠে আসে বেশকিছু পিকিংপন্থী হিন্দু কমিউনিস্ট নেতার নাম। যারা দফার বিরোধিতা করেছিল, যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, এমনকি যুদ্ধের পরেও পার্টির নাম থেকেপূর্ব পাকিস্তানবাদ দিতে অস্বীকার করেছে, তাদের বিষয়গুলো বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। এছাড়াও তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় যে, পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে মাঠপর্যায়ে মূল অপকর্ম করেছিল এই চীনপন্থী কমিউনিস্টরাই, কথিত ইসলামপন্থীরা ছিল গৌণ।

কারণ বর্তমানে সময়ের যে জামায়াত, হেফাজত এদের সক্রিয়তা মাঠপর্যায়ে দেখা যায়, একাত্তরের বিশ্বপরিস্থিতি তা ছিল না। বর্তমানে বাম দলগুলোর বেহাল দশা দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু সে সময়কার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুবসমাজের মধ্যে মূলধারার রাজনৈতিক দল ছিল বামপন্থী দলগুলোই। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছিল সোভিয়েতপন্থী রাজনৈতিক দল, বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ছিল চীনপন্থী। রাজনৈতিক দল বলতে ব্যাপকার্থে গ্রহণযোগ্যতা তখন এদেরই ছিল। ষাট-সত্তরের দশক হচ্ছে সারাবিশ্বে বাম রাজনীতির উত্থানের সময়। বিপরীতে কথিত ইসলামী দলগুলোর উত্থান ঘটে নব্বইয়ের দশকে, যখন সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আফগানিস্তানে হেরে গেলে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটে, ফলে কমিউনিজমেরও পতন হয় এবং কথিত ইসলামপন্থীরা ফ্রন্টলাইনে চলে আসে।

 এসব উত্থান-পতনের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে আন্তর্জাতিক ইহুদী-খ্রিস্টান চক্রান্তকারীরা। সুতরাং কথিত ইসলামপন্থীরা একাত্তরে ব্যাপক আকারের রাজাকার বাহিনী, স্বাধীনতা বিরোধী সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনা করেছে, একাত্তরের সমসাময়িক ভূ- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা সত্য হতে পারে না। মওদুদী, গোআযমের ন্যায় এদের নেতাগোছের লোকেরা পাক হানাদারদের সাথে আঁতাত করেছে এটা সত্য, কিন্তু এরা ব্যাপকার্থে বাহিনী পরিচালনার মতো জনসমর্থন কখনোই রাখত না।  উল্লেখ্য, এই মওদুদীপন্থী জামাত দলটি আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক-অগুরুত্বপূর্ণ একটি দল। এর একটি বড় কারণ, মওদুদী ৪৭ পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল। বিপরীতে তৎকালীন সময়ে গুরুত্ব রাখতো চীনপন্থী বাম দলগুলো, তারাই ব্যাপক আকারে সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এটাই বাস্তব ইতিহাস।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যেদালাল আইনকরা হয়েছিল, এর বিপক্ষে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল ভাসানী ন্যাপ এবং সিরাজুল আলম খানের জাসদ। কারণ গতানুগতিক ধারণা অনুযায়ী যে কথিত ইসলামপন্থী দলগুলোকেদালাল আইনএর মূল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রচার করা হয়, ঐতিহাসিক সত্য তা নয়।দালাল আইনএর গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কিছু কথিত ইসলামপন্থী থেকে থাকলেও বৃহদাংশই ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ বিরোধী চীনপন্থীদের থেকে আগত, যাদের গ্রেফতার করার কারণে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে ভাসানী জনসভায় আপত্তি তুলে বলেছিলেন, “সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দালালীর অভিযোগে সরকারবিরোধী প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীদেরকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক রাখছেন।

যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই এসব চীনপন্থীদের দমনে ভারতের মধ্যেই গঠিত হতে থাকেমুজিব বাহিনী যদি ইসলামপন্থীরাই তাদের ভাষ্যমতে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মূল হুমকি হতো, সেক্ষেত্রে চীনপন্থী দমনেমুজিব বাহিনীগঠন না করে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধেই তা গঠিত হত। উদাহরণস্বরূপ, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে এরকম বাহিনী ছিল গামাল নাসেরের। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কিন্তু তা হয়নি।

(৪) 

চীনপন্থী যেসব গোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরে ছিল, তারা ছিল অধিকতর কট্টরপন্থী (নকশালপন্থী নামে পরিচিত) পাকিস্তানের দোসর। তারা মুক্তিযুদ্ধকেদুই কুকুরের লড়াইনামে আখ্যায়িত করেছিল। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে ভারত হতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা অবস্থাপন্ন গৃহস্থ কৃষক দেশের অভ্যন্তরের এসব নকশালপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বারা শহীদ হয়েছে। অপরদিকে ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থীদের অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী অংশটি ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি তারা আওয়ামী লীগের অধীনে করতে রাজি হয়নি, যেহেতু আওয়ামী লীগ ছিল সোভিয়েত ভারতপন্থী। তাই চীনপন্থীরা ভাসানীর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারকে ডিঙিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সমমনা দল সিপিএমের সহায়তায় সমান্তরাল আরেকটি জোটবাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিগঠন করে।

এটি স্বাভাবিক যে, এধরণের সমান্তরাল আরেকটি জোটের দ্বারা কাজের কাজ কিছুই হয়নি, উল্টো তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিভেদের সৃষ্টি করেছিল মাত্র। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে এসব চীনপন্থী দলগুলোর কার্যক্রম প্রসঙ্গে জগলুল আলম রচিতবাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-৮৯বইতে উল্লেখ রয়েছে-

ভাসানীর নেতৃত্বে কলকাতায় জুন মাসে গঠন করা হয়বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি এই কমিটিতে যেসব বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধ হয় সেগুলো হল কাজী জাফরের কমিউনিস্ট পার্টি, নজরুল ইসলামের কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র, ভাসানীর ন্যাপ, শুভ রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পৃথক একটি অংশ, কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ, পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন। আটটি বামপন্থী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি অষ্টবাম নামেও পরিচিতি অর্জন করে। ভাসানী এই সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়।

...সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে, ভাসানীকে তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির বারংবার আবেদন সত্ত্বেও কমিটির কোনো প্রতিনিধিকে উপদেষ্টা পরিষদে নেয়া হয়নি। অনেকগুলো কারণে সমন্বয় কমিটিকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেয়া হয়নি বলে মনে করা হয়-

প্রথমতঃ নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতে অবস্থানরত প্রায় সব কয়টি চীনপন্থী ছাত্র বাম দল একত্রিত হয়ে মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করলেও এই কমিটি উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করতে পারেনি। এর অস্তিত্ব ছিল কেবলমাত্র কাগজে কলমে এবং সময়ে সময়ে পত্রিকায় বিবৃতি দেয়া ছাড়া কমিটি তেমন কোনো কাজও করেনি।

দ্বিতীয়তঃ সমন্বয় কমিটি তার নীতিমালায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) ব্যাখ্যাকৃতদুই কুকুরের লড়াইথিসিস এড়িয়ে যায় এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণীশত্রু খতমের ধারণাও সুস্পষ্ট বিবেচনায় আনেনি। কমিটিতে ন্যাপকে বাদ দিলে এই দুটিই ছিল পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল। ফলে এদের থিসিসকে বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা কমিটির পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছিল।

তৃতীয়তঃ সমন্বয় কমিটির সদস্য দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে মূল্যায়ন করে তাতে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের উত্থানের প্রশ্নটিকে কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মাধ্যম ক্রমশঃ বিকশিত হচ্ছিল একটি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং আওয়ামী লীগ জনগণের সেই জাতীয়তাবাদী চেতনারই পুরোপুরি সুযোগ নেয়। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে- যার ফলে সমন্বয় কমিটির পক্ষে জনগণের সমর্থন আদায় করে পূর্ণাঙ্গ শক্তি হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

চতুর্থতঃ প্রাথমিক অবস্থায় কমিটি গঠনের সময় ভাসানী সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীকালে ক্রমশঃ কমিটি থেকে দূরে সরে যায়। এমতাবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম) সমন্বয় কমিটির উপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালায়। এতে করে সমন্বয় কমিটির অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে কমিটির কার্যক্রম পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।

সমন্বয় কমিটি গঠনের মূল হোতা ভাসানী যতোই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রাম সফল করার পক্ষাবলম্বন করুক না কেন, লীগ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সবসময়েই ছিল সমন্বয় কমিটির ওপর খড়গহস্ত। কমিটির সবকয়টি দলই ছিল চীনপন্থী, অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চীনের পররাষ্ট্র নীতি ছিল পাকিস্তানের অনুকূলে। ফলে সোভিয়েত চিন্তাধারায় পুষ্ট আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের চীনপন্থীদের ওপর যেমন আস্থা স্থাপন করতে পারেনি, তেমনি কমিটির সঙ্গে যে কোনও রকমের ঘনিষ্ঠতা সেই সরকারকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের বিরাগভাজন করে তুলতে পারত, সে ঝুঁকি প্রবাসী সরকার কোনদিনই নিতে চায়নি।

অর্থাৎ ভারতে যেসব চীনপন্থীরা গিয়েছিল, তাদের দ্বারা মূলত কাজের কাজ কিছুই হয়নি মুক্তিসংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি করা ব্যতীত। বিপরীতে দেশে অবস্থানরত তাদের সঙ্গীরা মুক্তিযোদ্ধা মারার কাজটি ভালোভাবেই করেছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব দাবি করার বেলায় বর্তমানে এসব চীনপন্থীরাই কয়েক কাঠি এগিয়ে। এরাই বর্তমানে উল্টো আওয়ামী লীগকে চার্জ করছে যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল না করে তারামুক্তিযুদ্ধের চেতনালঙ্ঘন করছে। সূর্যের চেয়ে বালি গরম যাকে বলে!

তৎকালীন চীনপন্থীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় হায়দার আকবর খান রনো প্রসঙ্গে এক পত্রিকা সাক্ষাৎকারে দাবি করেছে- “১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি এই নামে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা আরো কিছু ছোটখাটো বামদের জড়ো করে ভাসানীকে প্রধান করেবাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিফ্রন্ট গঠন করি।... যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি করেছে পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। আমাদের ১৪টি ঘাঁটি ছিল। মুক্ত এলাকা ছিল ১৪টি। ভারতের কোনো সাহায্য আমরা পাইনি। বরং ভারতের বাধা পেয়েছি। সশস্ত্র সৈনিক ছিল ৩০ হাজারের ওপরে। (‘আমরা একে একে সবাইকে হারালাম’, কালের কণ্ঠ, ১৩ই মার্চ ২০২০)

অর্থাৎ যেই চীনপন্থীরা ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধী, তারাই নাকি সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছে! তাদের দাবি অনুযায়ী তাদের ১৪টি মুক্তাঞ্চল, ১৪টি ঘাঁটি তথা হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, বিরাট কারবার ছিল! বিপরীতেবাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-৮৯বইতে স্পষ্টতই উল্লেখ রয়েছে যে, এসব চীনপন্থীদের কার্যক্রম ছিল নামকাওয়াস্তে, যে কারণে তাদের কথিত সমন্বয় কমিটির কোনো প্রতিনিধিকেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়নি। বইটির ৬২ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে-

বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গণমুক্তি বাহিনী সংগঠনের কথা বলা হলেও আদতে একটি গ্রামেও কমিটির নেতৃত্বে কোনো বাহিনী গড়ে তোলা যায়নি। এর মূল কারণ ছিল এই যে, সমন্বয় কমিটি অনেকগুলো চীনপন্থী দলের সমাহার হলেও সেসমস্ত দলের বেশীর ভাগ ছিল দলছুট চীনপন্থীদের নিয়ে গঠিত। নিজ নিজ মূল দলের সঙ্গে কোন্দলে জড়িয়ে ফেলায় অভ্যন্তরীণ দলীয় সংকট নিয়ে বেশীর ভাগ চীনাপন্থী নেতা ছিল বিব্রত। সকলের সঙ্গে মিলে কাজ করার মত মানসিকতা তাদের ছিল না।

অর্থাৎ ভারতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের নাম করে যেসব চীনপন্থীরা গিয়েছিল, তারা ছিল দলছুট তথা অপ্রধান। মূল চীনপন্থীরা তো দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাতেই লিপ্ত ছিল। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব চীনপন্থীদের চাই এবং তা আদায়ের সহজ উপায় হলো-

মুসলমানদের গায়ে কালি লাগাও! ইসলাম মুসলমানদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করাও। সাথে ধুতি তুলে ভারত পালানো মুশরিক জনগোষ্ঠীকে চেতনার ফরমাবরদার বানাও! এমন ধারা চালু কর, যেন যে সবচেয়ে বেশি ইসলামবিদ্বেষী, সে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে নিকটবর্তী বলে প্রচারিত হয়! তাহলেই চীনপন্থীরা একাত্তরে দালালির ইতিহাস মুছে দিতে তো পারবেই, একইসাথে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় অধিকতর দ্বীন ইসলাম বিদ্বেষ প্রদর্শনে সক্ষম হওয়ায় তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বজাধারী অবিসংবাদিত গোষ্ঠী হিসেবেও তুলে ধরতে পারবে।

এমনকি খোদ আওয়ামী লীগকেও ধমক দিয়ে বলতে পারবে যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না সরানোতে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লঙ্ঘন করছে, সাথে নিজেদের মনঃপূত না হলে যে কাউকে রাজাকার বানিয়ে দিতেও কোনো বেগ পেতে হবে না। এক ঢিলে হাজারো পাখি মারার এমন নজির বিশ্বে বিরল!

(৫)

মস্কোপন্থীরা ছিল সংস্কারে বিশ্বাসী। রাশিয়ায় স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভের সংস্কার অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশের মস্কোপন্থী দলগুলো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোয়ালিশন করার অনুমতি পায়। সে হিসেবে বাংলাদেশের মস্কোপন্থী দলগুলো আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন গঠন করেছিল। বিপরীতে পিকিংপন্থীরা ছিল মৌলবাদী কমিউনিস্ট, লেনিন-মার্ক্সের মূল তত্ত্ব তারা ত্যাগ করতে চায়নি।

 এই বৈপরীত্যের নজির বর্তমান সময়েও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে ছাত্র ইউনিয়ন দলটি ভাগ হলে মস্কোপন্থীদের নেতৃত্ব দেয় মতিয়া চৌধুরী, বিপরীতে পিকিংপন্থীদের নিয়ে আলাদা হয় রাশেদ খান মেনন। বর্তমানে মতিয়া চৌধুরী ইসলামবিদ্বেষী বলে পরিচিত নয়, আম পাবলিক তার কমিউনিস্ট অতীত সম্পর্কে জানেও না। বিপরীতে রাশেদ খান মেনন এখনও ঝাঁজালো ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এতেই তাকে মানুষ কমিউনিস্ট বলে চিনে নেয়।

ন্যাপ দলটি ভাগ হলে চীনপন্থীরা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং মস্কোপন্থীরা অধ্যাপক মোজাফফরের নেতৃত্বে আলাদা হয়েছিল। অধ্যাপক মোজাফফরের একটি সাক্ষাৎকার এমআর আখতার মুকুল তারআমি বিজয় দেখেছিবইয়ের ৩৭২ পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন, যার অংশবিশেষ হলো-“স্বাধীনতার পর ন্যাপ ভেঙেছে তিনটি কারণে। ধর্মীয় চিন্তা চেতনা, আন্দোলন জাতীয়তাবোধ। আমরা ধর্মের স্বপক্ষে, হঠকারী আন্দোলনের বিপক্ষে।

উল্লেখ্য, মস্কোপন্থীদের ইসলামবিদ্বেষ হচ্ছে ধর্মের মোড়কে ইসলামবিদ্বেষ, যেভাবে তাদের সমাজতন্ত্রও হলো বুর্জোয়া দলের ছায়াতলে সমাজতন্ত্র। সামনাসামনি এরা দাবি করবে যে, কুরআন সুন্নাহর বিরুদ্ধে আইন পাশ হবে না। এরা দাবি করবে যে, এরা নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়ে! এদের দলের নেতা রীতিমতো ওলীআল্লাহ হয়ে গেছে! কিন্তু মাঠপর্যায়ে ঠিকই এরা জায়গায় জায়গায় মসজিদ ভাঙবে, গরু কুরবানীতে বাধার সৃষ্টি করবে, চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করে হিন্দুদের প্রাধান্য দিবে, এদের শাসনামলেই সর্বাধিক পরিমাণ ইসলামবিদ্বেষী কার্যক্রম সংঘটিত হবে এদের মৌন সমর্থনের কারণে।

ঠিক এর বিপরীতটিই হলো চীনপন্থী কমিউনিস্টরা, তারা হঠকারী আন্দোলন তথা নকশাল আন্দোলনের নামে নির্বিচারে গ্রামাঞ্চলের জোতদার অবস্থাপন্ন কৃষকদের হত্যা এবং কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী নীতিতে বিশ্বাসী। বর্তমানে এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে নানাবিধ ধ্বংসাত্মক প্রচারণা এবং অনলাইনে নাস্তিকতা-ইসলামবিদ্বেষ প্রচারের পেছনে রয়েছে সাবেক চীনপন্থীদের হাত। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা কট্টর ইসলাম বিদ্বেষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাপকাঠি হিসেবে প্রচার করে এবং সেই মাপকাঠিতে তারা আওয়ামী লীগেরও বিরোধিতা করে, যে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছে।

পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, এতে করে তারা যে মূলত পাকিস্তানের দোসর ছিল একাত্তরে, এই ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে যায়, সাথে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বজাধারী সেজে অন্যদের উপর খবরদারি ফলানো যায়। শুধু একাত্তরের পূর্বে নয়, পরেও এরাই সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে।  কট্টর মাওবাদী সর্বহারা দলের নেতা সিরাজ শিকদারের বোন শামীম শিকদার, সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাসের নিকট সাক্ষাৎকারে বলেছে যে সে শেখ মুজিবকে মারার বহু চেষ্টা করেছিল। সর্বহারা পার্টি তাকে একটি রিভলবার দিয়েছিল শেখ মুজিবকে হত্যা করার জন্য।

শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি, প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানাল। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন। সে স্মৃতিচারণ করে বললো, ‘আমি ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাকে আমার গুলির দুরত্বের ভেতরে আনতে পারলাম না। ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।” (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, মাসকারেনহাস, পৃষ্ঠা ৫৩)

কট্টর ইসলামবিদ্বেষী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীদ্বিখণ্ডিত’-তে এই শামীম শিকদার সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- “পরনে শার্ট প্যান্ট, পায়ে শক্ত জুতো। হাতে প্রয়োজন হলে রিভলবার রাখে। সেই কিশোরী বয়স থেকেই শামীম শিকদারের কথা যত শুনেছি, শ্রদ্ধায় আমার তত মাথা নত হয়েছে। শামীম আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, “ভয় পাবা না, ভয় পাবা না। মোল্লা হারামজাদাগুলো কিচ্ছু করতে পারবে না। অত সোজা নাকি? তুমি ভয় পাইলেই ওরা মাথায় উঠবে। যা লিখতাছ লেইখা যাও। আমরা আছি। কোনও অসুবিধা হইলে আমারে খবর দিবা। দেখি তোমারে কোন শালায় কি করে। পিটাইয়া হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিব। ...আরে দুই তিনটারে যদি ঘুসি দিয়া ফালাইয়া দিতে পারো, টুপি পাঞ্জাবি খুইল্যা ... কইরা ছাড়তে পার, ওরা তোমার নাম আর মুখেও নিবে না।

সিরাজ শিকদারের বোন এই কট্টর ইসলামবিদ্বেষী শামীম শিকদার শেখ মুজিবকে হত্যা করতে সক্ষম না হলেও তা পেরেছিল সিরাজ শিকদারের শিষ্য মেজর নুর। গত ১৩ই আগস্ট, ২০১৪-তে প্রকাশিতআমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিশিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক কলামে উল্লেখ করা হয়-“মেজর নুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিল, পরে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়। সিরাজ শিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনায় সে ক্ষুব্ধ হয়। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নুর বলে, ‘ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি।

মুক্তিযুদ্ধের চলাকালীন সময়ে তার আগে-পরে চীনপন্থীদের এসব স্বাধীনতাবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে খোদ আওয়ামী লীগও নীরব। উল্টো একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সিরাজ শিকদারের সর্বহারা বাহিনীর সদস্য জাদুকর গৌরাঙ্গলাল আইচ ওরফে জুয়েল আইচকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারএকুশে পদকদিয়েছে। এই গৌরাঙ্গলাল আইচ বিডিনিউজের এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে চূড়ান্ত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে মন্তব্য করেছে-

এখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়ে গেছে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম থাকে নাকি? রাষ্ট্র কি কোন জীব নাকি যে তার ধর্ম থাকবে? সোনার পাথর বাটি হয়ে গেছে। এবং সেই যে আঠা লেগেছে, নোংরা আঠা, সেই আঠা কেউ ছাড়াতে পারছে না।” (https://arts.bdnews24.com/?p=9248)

চীনপন্থী কমিউনিস্টদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধী বিধায় ভারতে তারা ছিল সোভিয়েতপন্থী কংগ্রেস দলটিরও বিরোধী। যে কারণে ভারতে অতীতের কংগ্রেসবিরোধী বিভিন্ন কোয়ালিশনে সেখানকার পিকিংপন্থীসিপিএমদলটি বিজেপির সাথেও জোট বেঁধেছে। অর্থাৎ চীনপন্থী কমিউনিস্টদের রয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতি সমর্থন, যার সার্থক উদাহরণ হচ্ছে শাহরিয়ার কবির ওরফে মুরগি কবির। সম্প্রতি মোদিকে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে সে সবচেয়ে বেশি সমর্থন জানিয়েছে, এমনকি পত্রিকা সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে বিজেপি সরকার কর্তৃক কারফিউ আরোপ করায় সে দিয়েছে নির্লজ্জ সমর্থন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে হিন্দুত্ববাদীদের সাথে মিশে তীব্র ইসলামবিদ্বেষী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এদেশের চীনপন্থীরা, ব্লগ-অনলাইনে এবং অফলাইনে।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে মুসলমানদের দাঁড় করানোতে, দ্বীন ইসলামকে প্রতিপক্ষ বানানোর মাঝে আওয়ামী লীগেরও ফায়দা রয়েছে। এটা ভুললে চলবে না যে, আওয়ামী লীগ চীনপন্থী বাম না হলেও মস্কোপন্থী। চীনা কুকুরের মতো সে খালি কলসি নয় বিধায় নাস্তিক্যবাদী তর্জন-গর্জন কম করলেও, ইসলাম বিদ্বেষ তারও ষোলআনা রয়েছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সে- কখনোই আপন মনে করে না। দ্বীন ইসলামকে প্রতিপক্ষ বানালে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিয়ে কামড়াকামড়ি অন্তত এই দুই কুকুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এটি দুই পক্ষই উপলব্ধি করতে পারে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে ইসলাম বিদ্বেষী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে তারা উভয়ই একমত।

সবচেয়ে বড় কথা, মুজিব বাহিনীর দ্বারা ১৪ই ডিসেম্বরের পিকিংপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার যে দায়, তার থেকে মস্কোপন্থীরা মুক্ত থাকতে পারে এদেশের দ্বীনদার মুসলমান শ্রেণীটির ওপর একাত্তরের অপকর্মের দায় চাপালে। তাই বর্তমান সরকার সবকিছু জানার পরও নীরব থেকে মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এদেশের চলমান ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে।

(৬) 

মণি ভাই দৈনিক বাংলার বাণী প্রকাশ করলেন। তার ইচ্ছে সাংবাদিকতাকে পিকিংপন্থীদের হাত থেকে মুক্ত করা। এটা ঠিক পাক আমল থেকে বাংলাদেশ হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকতা ছিল পিকিংপন্থীদের কব্জায়। মণি ভাই বেঁচে থাকলে দেখতেন পিকিংপন্থীরা কিভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে।” (মণি ভাই বেঁচে থাকলে দেখতেন, দৈনিক মানবজমিন, মতিউর রহমান চৌধুরী, ০৯-০৩-২০১৬)

সাংবাদিকতা ছিল পিকিংপন্থীদের কব্জায়এই বক্তব্যের দ্বারা বোঝা যায় যে, তৎকালীন সময়ে শিক্ষক-লেখক-সাংবাদিক এদের মধ্যে যারা বামপন্থী ছিল, তারা প্রায় সকলেই ছিল পিকিংপন্থী। এসব পিকিংপন্থীরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে নিজ নিজ কর্মস্থলে গিয়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের হয়ে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, শাহরিয়ার কবির, শামসুর রাহমান, কবির চৌধুরী এরা একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানেই থেকেছে এবং পাকিস্তান সরকারের চাকরি-ব্যবসা করেই খেয়েছে (এখানেই কিন্তু পাবলিক বিভ্রান্তিতে ভোগে যে শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুন এরা কোন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল) স্বাধীনতার পর এই গোষ্ঠীভুক্তরাই কট্টর ইসলামবিদ্বেষী চেতনাকে পুঁজি করে এদেশের দ্বীনদার মুসলমান সমাজকে ঢালাওভাবে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে একঘরে করে দেয়।

শেখ মণি মস্কোপন্থী হিসেবে এসব পিকিংপন্থীদেরই দমন করতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যেই তিনি ভারতে থাকতে গড়ে তোলেনমুজিব বাহিনী’, পরবর্তীতে যেই মুজিবাহিনীর নেতাদের অধীনেরক্ষীবাহিনীগড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশে এই মুজিব বাহিনী কর্তৃক ১৪ই ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা জহির রায়হান ফাঁস করে দেবে বলে হুমকি দেয়ায় তাকেও গুম করে দেয়া হয়। প্রসঙ্গে নির্মল সেনেরআমার জবানবন্দিবইয়ের ৪০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে-পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অংশটির লক্ষ্য ছিল-বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে। তারপর আর ফিরে আসেনি। মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে। তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, আল বাদর, আলশামস, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায়- মুক্তিবাহিনীর অংশটি মুজিববাহিনী। ১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিববাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল-রাজাকার, শান্তি কমিটি সহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নিঃশেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোনো মহল থেকেই বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিববাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোনো ব্যাপারেই উচ্চবাচ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে।

জহির রায়হানের অন্তর্ধান নাকি হত্যাকাণ্ড? প্রসঙ্গে বেশ লেখালেখি হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় তার স্ত্রী সুমিতা শ্যালিকা ববিতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। জহির রায়হানের স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা মনে করে, জহিরকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে বলে প্রচার চালিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। আর শ্যালিকা অভিনেত্রী ববিতা জোর দিয়ে বলেছে, যুদ্ধের সময়ে কলকাতার অনেকের কাণ্ডকীর্তি জহির জানত। এগুলো যাতে ফাঁস না হয়ে পড়ে, সে জন্যই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ঘনিষ্ঠজনদের আরো কেউ বক্তব্য দিয়েছে তার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।” (সূত্রঃ সাপ্তাহিক নতুনপত্র, ১৬ ফেব্রুয়ারি-১৯৯৯)

উল্লেখ্য, জহির রায়হানের নিকট বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য তো ছিলই, এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাসে আওয়ামী লীগ নেতারা কলকাতায় কি কি অপকর্ম করেছিল, সেটার দলিলও তার নিকট রক্ষিত ছিল। ১৯৭২ সালের ২৫শে জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা দেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে নীলনকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে রয়েছে, যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কি চরিত্র ছিল।’ (ভাসানী-মুজিব-জিয়া, জিবলু রহমান, পৃষ্ঠা ২৬)

অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মাসে কলকাতার অপকর্ম ধামাচাপা দিতে চীনপন্থীদের ন্যায় মস্কোপন্থী আওয়ামী লীগেরও সফট টার্গেট, মুসলমান ইসলাম। অথচ মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র চিঠিতে বারংবার কুরআন শরীফের আয়াত, জিহাদের উল্লেখ প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল কৃতিত্ব এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার। তা মুক্তিযুদ্ধকেদুই কুকুরের লড়াইআখ্যা দেয়া চীনপন্থীদের নয় কিংবা যুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতায় অপকর্মে লিপ্ত থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদেরও নয়। কিন্তু আফসোসের বিষয়, চীনপন্থী আওয়ামী লীগ, উভয়েই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে। বিপরীতে এদেশে মুসলমানদের অবস্থান তুলে ধরার মতো, তাদের নেতৃত্ব প্রদানের মতো, তাদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো প্রতিষ্ঠান নেতৃত্ব না থাকায় তাদেরকেই ভিলেন হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে।

আগের পর্বঃ https://www.facebook.com/rajdarbaar.returns/posts/1492829484228532

নোটঃ  দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, পিকিংপন্থীরা পাকিস্তান আমলের পূর্বে মিডিয়াতে সক্রিয় ছিল, এখন নাকি তারা ইতিহাস! অথচ শাহরিয়ার কবিরের সম্পাদনায় প্রকাশিতসাপ্তাহিক বিচিত্রা’, রাশেদ খান মেননের ভাই এনায়েতুল্লাহ খানেরহলিডেপত্রিকাগুলো স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে জনমত নিয়ে যাওয়া এবং তার হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বেশী দায়ী ছিল। তার সাথে এই পত্রিকাগুলোই কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষ সর্বস্বস্বাধীনতার চেতনা মূল ধ্বজাধারী ছিল। বিবি রাসেল-আড়ং মার্কা নানাবিধ উগ্র ইসলামবিদ্বেষী ফ্যাশন হাউজ সুন্দরী প্রতিযোগিতার পূর্বসূরী হচ্ছে পিকিংপন্থীদের পরিচালিত এইসাপ্তাহিক বিচিত্রাপত্রিকাটি। এই বিচিত্রা পত্রিকাটির মাধ্যমেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথমফটোসুন্দরীপ্রতিযোগিতা, ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার নামে সমাজে ইসলামী আবহ ধ্বংসের সূচনা হয়।

জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার, উভয়ই ছিল পিকিংপন্থী বামদের নেতৃস্থানীয়। আবার জহির রায়হানের চাচাতো ভাই ছিল শাহরিয়ার কবির, পিকিংপন্থী বিচিত্রা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। জহির রায়হান যেই ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে ফিল্ম শো করে আওয়ামী লীগের কুর্কীতি ফাঁসের ঘোষণা দিয়েছিল, সেই ৩০শে জানুয়ারি সকালেই তার গাড়ি থেকে অপহরণ করে তাকে গুম করা হয়।

(৭)

ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বৈধতা আদায় ইহুদীরা যে বিষয়টিকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে, তা হচ্ছে তাদের কথিত ‘হলোকাস্ট’। পশ্চিমা বিভিন্ন টিভি-সিনেমা-বইপত্রের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয় যে, ঐ যুদ্ধটি যেন হয়েছিল ইহুদী সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ এক কথায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের ইহুদীকরণ করা হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদারিত্বকে বৈধতা দানের লক্ষ্যে। 

যদিও বাস্তবতা হলো, তখন জার্মানি বা কারো নিকটই বিশেষ গুরুত্ব রাখত না এই ইহুদী সম্প্রদায়।   সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘হিটলার’ বইতে উল্লেখ রয়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন জার্মান জনগণ এই কথিত ইহুদী গণহত্যা সম্পর্কে কিছুই জানত না। অর্থাৎ বর্তমানে ভারতে কিংবা মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যার ক্ষেত্রে যে সেসব দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়, ঘৃণার বিস্তার পরিলক্ষিত হয়, তৎকালীন জার্মান সমাজে ইহুদীদের প্রতি এর কিছুই পরিলক্ষিত হয়নি। কারণ ইহুদী নির্যাতনের যেসব কল্পকাহিনী বর্তমানে মিডিয়াতে যেভাবে প্রচার করা হয়, সেরকম কিছুই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটেনি। তারপরও যেভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’র ইতিহাসকে ইহুদী দখলদারিত্বের স্বার্থে ‘ইহুদীকরণ’ করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করা হয়েছে ‘হিন্দুকরণ’। 

এই ইতিহাসের ‘হিন্দুকরণ’ করার স্বার্থে একটি অসত্য তথ্য প্রচার করা হয় যে, একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা হয়েছিল কেবল কথিত ‘ইসলামী’ চেতনার বশবর্তী হয়ে। যদি তা-ই হতো, তবে চাকমা প্রধান ত্রিদিব রায় কিংবা তৎকালীন প্রধান বৌদ্ধধর্মীয় নেতা বিশুদ্ধানন্দ পাকিস্তানের পক্ষ নিবে কেন? কারণ একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার ভূ-রাজনৈতিক কারণ উপস্থিত ছিল আর তা হলো ভারতের বিরোধিতা ও চীনের সমর্থন। 

আর চীনের সমর্থনের বিষয়টি কেবল বৌদ্ধদের মধ্যে নয়, বরং হিন্দু সমর্থক-কর্মী অধ্যুষিত চীনপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যেও উপস্থিত ছিল এবং এ কারণেই তারা যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছে। এই চীনপন্থী কমিউনিস্টরাই ছিল আওয়ামী লীগের প্রধানতম শত্রু এবং স্বাধীনতা প্রক্রিয়ার মূল বিরোধী। যে কারণে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল হক মনি যুদ্ধকালীন সময়েই স্বাধীন দেশে চীনপন্থীদের দমনে গড়ে তোলে ‘মুজিব বাহিনী’। এখানে অবধারিতভাবে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যদি প্রচলিত বয়ান অনুযায়ী কথিত ইসলামপন্থীরা মূল শত্রু হতো, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিশেষায়িত বাহিনী গঠিত হলো না কেন? কেন চীনপন্থী দমনেই গঠিত হলো ‘রক্ষী বাহিনী’?

এমনকি ‘দালাল আইন’ এর মূল বিরোধিতা কারীরাও ছিল চীনপন্থী ভাসানী ন্যাপ। কারণ ১৯৭৩ এর নির্বাচনের পূর্বে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই আইন ব্যবহার করে আওয়ামী বিরোধী ন্যাপ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, আবার নির্বাচন শেষে তাদেরকে কথিত ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করে মুক্তিও দেয়া হয়। তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রধান শক্তি ছিল রুশপন্থী আওয়ামী লীগ ও চীনপন্থী ন্যাপ-সর্বহারা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সাথে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবিদার জাসদ। এরাই ছিল রাজনীতির ময়দানে পক্ষ-বিপক্ষের মূল কুশীলব, কথিত ইসলামপন্থীদেরকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রচার করা হয় তা নিরেট ঐতিহাসিক মিথ্যাচার বৈ কিছু নয়। 

উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা ও প্রচারপত্রে ইসলামী অনুষঙ্গের ব্যাপকতা ও ইসলামী চেতনার নিরিখে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন প্রতিষ্ঠান নেই, এমন নেতৃত্ব নেই, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে একদা মস্কোর কুকুর ও চীনের কুকুর। এই দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উদ্ধার করাটা এখন সময়ের দাবি। 

সে জন্য মুসলমানদের নিজস্ব নেতৃত্ব, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান খুঁজে নিতে হবে আর মুসলমানদের নিজস্ব কিছু পেতে হলে চাই তাদের সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ, মুসলমানিত্বের উন্মেষ। মুসলমানকে মুসলমান হিসেবে তাদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, প্রতিপক্ষের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে হবে। তবেই তারা এই দেশকে, এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কৃতিত্বকে মুসলমান হিসেবে বুঝে নিতে পারবে।


Post a Comment

 
Top