বাঙালি মুসলমানের মুক্তিলাভের প্রক্রিয়া কি, তা বুঝতে হলে হিন্দুদের উত্থান কিভাবে হয়েছিল তার ইতিহাস জানতে হবে। ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ নামটি নিশ্চয়ই অনেকের জানা আছে। মুসলিম শাসনকেন্দ্র দিল্লী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এবং ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ, এই দুইয়ে মিলে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ অনুগত কলকাতার হিন্দুরা হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। এটাকেই তারা ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ বলে।

নীরদ সি চৌধুরী লিখেছে, “ হিন্দুস্তানে হিন্দু মাত্রেই সভ্য বলিয়া গৃহীত হইতে চাহিলে মুসলমানী রীতি ধরিত, অর্থাৎ তাহাদের ভাষা হইত উর্দু, পোশাক হইত আচকান ইত্যাদি, আদব-কায়দাও হইত মুসলমানসুলভ। এখন যেমন সামাজিক প্রতিষ্ঠা জন্য লোকে সাহেব হইতে চায়, তখন তাহারা মুসলমান হইত। ইহা ছাড়া সামাজিক জীবনে বিদগ্ধ হিন্দু, মুসলমানেরই সঙ্গে মেলামেশা করিত বেশি।”

এটা ছিল মুসলিম শাসনামলের অবস্থা, যার আমূল পরিবর্তন ঘটে ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরা ক্ষমতায়িত হবার পর। হিন্দুরা যদিও মুসলিম শাসনামলে মুসলিম এটিকেট পালন করত, কিন্তু তারা তা করত বাধ্য হয়ে, মন থেকে নয়। সিপাহী বিদ্রোহে মুসলিম শাসনকেন্দ্রের বিলুপ্তির পর এজন্য তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক হিন্দুত্বের জোয়ার বয়ে যায় এবং শত শত বছর ধরে যে মুসলিম আবহ বিরাজমান ছিল, সেটাকে হিন্দু-ব্রিটিশ উভয়েই বিলুপ্ত করতে তৎপর হয়ে উঠে। যার প্রতিফলন দেখা যায় বঙ্কিম, রবীন্দ্র এদের লেখায়। তীব্র ইসলামবিদ্বেষ তারা প্রকাশ করেছে তাদের অতীতের মুসলমানদের গোলামি করার ইতিহাস মুছে দেয়ার তাগিদে।

এটাই স্বাভাবিক, কারণ হাজার বছরের মুসলিম ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থা জারি করতে হলে মুসলমানদের সবকিছুকে ঘৃণা করতে হবে। এই যে মুসলিম প্রভাবমুক্ত করার প্রক্রিয়া এবং হিন্দুত্বের উত্থান, এটাকেই হিন্দুরা নাম দিয়েছিল ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’। নীরদ সি চৌধুরী তার অটোবায়োগ্রাফি অফ এন আননোন ইন্ডিয়ান বইতে লিখেছে যে-

The very first result of this renaissance was a progressive de- Islamization of the Hindus of India and a corresponding revival of Hindu traditions. The only non-Hindu influences which it recognized and tried to assimilate were European. All the thinkers and reformers of modern India from Rammohun Roy to Rabindra Nath Tagore based their life-work on the formula of a synthesis, by which they understood a synthesis of Hindu and European currents. Islamic trends and traditions did not touch even the arc of their consciousness.

অর্থাৎ কথিত রেনেসাঁর মূল ফলাফলই ছিল ইসলাম-বিযুক্তকরণ এবং হিন্দু আচারপ্রথার পুনরুত্থান। একমাত্র অহিন্দু প্রভাব যা হিন্দুরা গ্রহণ করেছিল, তা ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব। রামমোহন থেকে রবীন্দ্র, সকলেই এই হিন্দু এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিলনের প্রত্যাশী ছিল। ইসলামী সংস্কৃতির কোনোকিছুই তাদের চিন্তাধারার প্রান্তিক অংশেও স্থান পায়নি।

অর্থাৎ হিন্দুরা ইসলাম বা মুসলমানের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস, অথচ সেখানকার কোনো টিভি চ্যানেলেই ঈদ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানও প্রচার করা হয় না। এখন মুসলমানরা যদি পাল্টা নিজেদের পুনরুত্থান চায়, সেক্ষেত্রে অবশ্য অবশ্যই তাদেরকেও পাল্টা ঘৃণা প্রকাশ করতে হবে। রবীন্দ্র হবে সেই ঘৃণার একটি অংশ মাত্র, মূলত হিন্দুদের চাল-চলন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান- পোষাক- খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুকে ঘৃণা করতে হবে, অস্বীকার করতে হবে, অগ্রাহ্য করতে হবে।

মুসলমানদের ঘৃণার মাধ্যমেই হিন্দুদের বিশেষায়িত সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটেছিল, সুতরাং মুসলমানদের বিশেষায়িত সাহিত্যের পূর্ণ পরিস্ফুটনের স্বার্থেই কম করে হলেও রবীন্দ্রকে ঘৃণা করতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, হিন্দুদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা যাবে না।

Post a Comment

 
Top