“মুসলমান হত্যাকে দৈনন্দিন কাজে নামিয়ে আনতে হবে, যেন এই হত্যা, হত্যার মত কোনো বিশেষ ঘটনা নয়, যেন এই হত্যা, হত্যার মত কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, যেন এই হত্যা, হত্যার মত কোনো অসামাজিকতা নয়, যেন এই হত্যা, আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের অন্তর্গত, আমাদের নিত্যকার্য পদ্ধতির অংশ। একজন মুসলমানকে হত্যার পক্ষে এই ঘটনাটাই যথেষ্ট শক্ত যুক্তি, যে সে মুসলমান।”
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ শহীদ করার ১ বছর পর কলকাতার প্রাবন্ধিক দেবেশ রায় লিখেছিল ‘দাঙ্গার প্রতিবেদন’ বইটি, তারই অংশবিশেষ উপরের উক্তিটি। উক্তিটি পড়লে মনে হয়, এটি বোধহয় লেখা হয়েছে ৯/১১ পরবর্তী আবহকে পুঁজি করে, কিন্তু না। তখনও ৯/১১ হয়নি, আফগানিস্তানে-ইরাকে যুদ্ধ হয়নি, বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চল তখনও শুরু হয়নি। সে সময়েই মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মনোভাব ছিল এরূপ।
উপরের উক্তিটি যদি কোনো মুসলমান লেখক লিখতো? সেক্ষেত্রে যা হতো, তা হলো হিন্দুরা তাকে রাজাকার-সাম্প্রদায়িক বলে পরিবেশ তাতিয়ে তুলতো। কিন্তু হিন্দুরা তো সংখ্যালঘু, সেটা মূল ধর্তব্য নয়। মূল সমস্যা এটাই হতো যে, লেখকের স্বজাতির মুসলমানরাই হিন্দুদের নিকট মুখ রক্ষার্থে তার সাথে সম্পর্ক বেমালুম অস্বীকার করত। ছি ছি তুমি হিন্দু ভাইদের ব্যাপারে এই কথা লিখেছো? লজ্জায় আমরা মুখ দেখাতে পারছি না!
একারণেই মুসলমানদের মধ্যে লেখক সৃষ্টি হওয়াটা দুষ্কর। ফরহাদ মজহার তার একটি পোস্টে লিখেছে যে, জয়া চ্যাটার্জি তার ‘বাংলা ভাগ হল’ বইতে হিন্দুরা যে বাংলা ভাগের জন্য দায়ী ছিল, এটি প্রমাণ করে তাদের উদ্ধার করেছে! কিন্তু আপনারা জয়া চ্যাটার্জির বইয়ের ভূমিকা পড়ে দেখবেন, সেখানে সে বলেছে যে বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন উমরের বইয়ের যে কালেকশন, সেখান থেকে রেফারেন্স নিয়ে সে ঐ বইটি লিখেছে।
অর্থাৎ বদরুদ্দীন উমরও চাইলে ঐরকম একটি বই লিখতে পারত, কিন্তু ঐ যে মুসলমান সমাজের অছাম্প্রদায়িক অথর্বতা। জয়া চ্যাটার্জি ঐ বই লেখায় পশ্চিমবঙ্গে তাকে প্রচুর গালমন্দ করা হয়েছে, কিন্তু নামের শেষে চ্যাটার্জি থাকায় তা একটি সীমার মধ্যে রয়েছে। নামের শেষে ‘উমর’ থাকা লেখক লিখলে, তাকে একেবারে ধর্ম তুলে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করত হিন্দুরা। যদিও সেটি বিষয় নয়, কারণ ইহুদী-খ্রিস্টান-হিন্দুদের ক্ষেত্রে এরকম ক্ষেত্রে গোটা সমাজ সাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে লেখকের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় তাকে ডিফেন্ড করতে, ফলে লেখকের ইমেজ ও ক্যারিয়ার নিরাপদ থাকে। কিন্তু মুসলমান সমাজ যেহেতু ‘অছাম্প্রদায়িক’, তারা উল্টো তাদের কথিত ‘হিন্দু ভাই’দের নিকট ভালো সাজতে গিয়ে লেখককে একঘরে করে দিতে প্রস্তুত।
শার্জিল ইমামের কথাই ধরুন, হিন্দুদের নিকট ভালো সাজতে গিয়ে ভারতীয় মুসলমানরা তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। একজন উদীয়মান বুদ্ধিজীবী এবং নেতা এখন জেলে, মুসলমান সমাজের অছাম্প্রদায়িক স্বার্থপরতার জন্য। হিন্দুদের জন্য লিখলে হিন্দুরা তাকে মাথায় তুলে রাখত, কিন্তু মুসলমানরা অছাম্প্রদায়িকতার কারণে প্রতিভার কদর করতে জানে না। অছাম্প্রদায়িক জাত কেবল ভাত আর কাপড় চেনে। বিপরীতে সাম্প্রদায়িক জাতি সবসময় দেখে কে তার হয়ে বললো, কে তার হয়ে লিখলো।
এসব কারণে মুসলমানদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হোক, নেতা হোক জন্মায় না। অছাম্প্রদায়িকতার জমীনে কেবল দালালেরাই জন্মায়, বিপরীতে সাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতেই জন্ম নেয় জাতির বুদ্ধি ও মুক্তির নেতৃত্ব।

Post a Comment

 
Top