উপরের মন্তব্যটি করেছে পশ্চিমবঙ্গের এক হিন্দু ইতিহাসবিদ কালিকারঞ্জন কানুনগো। এর আগে ভারতের সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘পদ্মাবতী’ সিনেমা নিয়ে যে পোস্ট দিয়েছিলাম, তার জন্য আমাকে কিছু বই পড়তে হয়েছে, যার একটি হলো ‘টডের রাজস্থান’। এই ‘টড’ নামক ব্যক্তিটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিল, যে মুসলিমবিরোধী কতগুলো ভুয়া ইতিহাসকে একত্রিত করে ‘রাজস্থান’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিল ১৮৩০ সালে।

কালক্রমে সঠিক ইতিহাসের বিচারে তার পুরো বইটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। দিব্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘টডের রাজস্থান’ বইয়ের ভূমিকায় এজন্য বলা হয়েছে, এই বইটির ইতিহাস অধিকাংশই মিথ্যা, কেউ যদি সঠিক ইতিহাস জানতে চায় তাহলে সে যেন কালিকারঞ্জন কানুনগোর ‘রাজস্থান-কাহিনী’ বইটি পড়ে নেয়।

টড রচিত মিথ্যা বইটির উপর ভিত্তি করে প্রচুর হিন্দুয়ানী সাহিত্য রচিত হয়েছে, যেমন বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’, রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পতন’ প্রভৃতি। হিন্দুরা এসব বই পড়িয়ে তাদের সন্তানদের ইসলামবিরোধী দীক্ষা দিয়ে থাকে। এসব বইয়ের কাহিনী তাই হিন্দুরা ত্যাগ করতে পারে না, তা ইতিহাসের বিচারে যতোই ভুল প্রমাণিত হোক না কেন। কালিকারঞ্জন কানুনগো তার ‘রাজস্থান-কাহিনী’ বইতে এ সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করেছে। সে যখন পত্রিকায় লেখা শুরু করেছিল, তখন তার স্ত্রী পত্রিকা পড়া ছেড়ে দেয়। কারণ তার হিন্দু স্ত্রীর দৃষ্টিতে বঙ্কিমের ‘দেবী চৌধুরানী’ দ্বিজেন্দ্রর ‘মেবার পতন’ আসল ইতিহাস, কারণ সেগুলোতে মুসলিমবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। অন্যদিকে তার স্বামীর লেখায় হিন্দুয়ানী সাহিত্যের ঐতিহাসিক মিথ্যাচারগুলো ফুটে উঠে, যেগুলো পড়লে হিন্দুয়ানী চেতনা আর অক্ষুণ্ন থাকে না!

কিন্তু কালিকারঞ্জন কানুনগো নিজেও একজন গোঁড়া হিন্দু, সে মূলত ‘রাজস্থান-কাহিনী’ বইটি লিখেছে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য। বইয়ের শুরুতেই সেজন্য তার বক্তব্য-

“আধুনিক গবেষণায় টডের রচিত বইটির অধিকাংশ অংশই ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা হিন্দুরা বাল্যকাল থেকে যে সমস্ত কথা অবিসংবাদী সত্য বলে বিশ্বাস করি, যথা প্রতাপ ও শক্তশিংহের বিরোধ, শক্তশিংহের নির্বাসন, মানসিংহের অপমান, শক্তশিংহ কর্তৃক প্রতাপের প্রাণরক্ষা এগুলো সবই কাব্যনাটকের কল্পকাহিনী বলে মনে হয়। কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণ অশুদ্ধ হলেও রাম মিথ্যা হতে পারে না, মহাভারত অশুদ্ধ হলেও কৃষ্ণ মিথ্যা নয়। টডের ‘রাজস্থান’ অশুদ্ধ হলেও প্রতাপের ‘বীরত্বের’ কাহিনী যে মিথ্যা নয়, সেটা প্রমাণ করাই আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।”

ইতিহাসের বিচারে রামায়ণ অশুদ্ধ হলেও রামের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হবে, মহাভারত অশুদ্ধ হলেও কৃষ্ণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হবে! টডের বই মিথ্যা প্রমাণ করাটা কালিকারঞ্জনের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং টডের বই মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও যেন প্রতাপের কথিত ‘বীরত্বের’ ঝাণ্ডাকে খাড়া রাখা যায়, সেটিই তার ‘রাজস্থান কাহিনী’ বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মিথ্যাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং জোর করে মিথ্যার স্তম্ভকে ধরে রাখা, এর উপরই টিকে আছে হিন্দুদের অস্তিত্ব। চাইলেই একটা হিন্দু সেই মিথ্যাকে ত্যাগ করতে পারে না, কারণ কালিকারঞ্জনের ভাষায় ‘বাল্যকাল থেকে অবিসংবাদী সত্য’ বলে তারা তা বিশ্বাস করে। এর থেকে মুসলমানদের আসলে ফিকির করতে হবে যে, তারা কিছুতেই একজন হিন্দুকে তার বন্ধু হিসেবে পাবে না, কিছুতেই নয়। রীতিমতো অসম্ভব পর্যায়ের কুসংস্কার, মিথ্যাচার ও ভণ্ডামিকে মেনে নিয়েই একজন হিন্দুকে হিন্দু হতে হয়।

Post a Comment

 
Top