বগুড়ায় ব্যাটারীচালিত অটো রিকশা ভেঙে দেয়া নিয়ে বর্তমানে অনলাইনে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। আমরা এই যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, যে সরকার চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারে, এর মূল কারণ জনগণের প্রতিবাদহীনতা। কিন্তু বাঙালি মুসলমান তো ইতিহাসে কখনোই প্রতিবাদহীন ছিল না। ব্রিটিশ আমল থেকে একাত্তর, সর্বদাই বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।

আমি আমার এই পেজে কিছুদিন আগে মাধ্যমিকের ক্লাস ৯-১০ এর পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের কিছু অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। বর্তমানে নাহিদ-জাফর ইকবাল মার্কা সিলেবাসে পদার্থবিজ্ঞানের বইতে কোন গাণিতিক সমস্যার অনুশীলনী রাখা হয়নি, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রাণই হলো গিয়ে গণিত। বই থেকে মহাকর্ষের অধ্যায়টি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে, যে কারণে এখনকার এসএসসির ছাত্ররা মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বা G এর মানের মতো মৌলিক বিষয়ের ধারণাও রাখে না।

যে কারণে বর্তমানে নীলক্ষেত থেকে অনেকেই পুরনো সিলেবাসের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ফটোকপি কিনতে আসে, কারণ নতুন সিলেবাসের বই পড়ে কিছুই শেখা সম্ভব নয়। জনগণ পুরনো বই কিনে পড়ছে, কিন্তু তারপরও তারা প্রতিবাদ করছে না। শিক্ষকরা গণিতের সমস্যাবিহীন পদার্থবিজ্ঞান বই পড়িয়ে যাচ্ছে, তারাও কোন প্রতিবাদ করছে না।

এই প্রতিবাদহীনতার মূল কারণ, এই আওয়ামী লীগ আমলে জনগণ তার দ্বীন ইসলাম নিয়ে আপোস করতে শিখেছে, ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আপোস করতে শিখেছে। বছর কয়েক আগে ইসলাম শিক্ষা বইয়ের ভেতরে যখন লেখা ছিল ‘দেবদেবীর নামে জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া জায়েয’ তখন অভিভাবকেরা এর প্রতিবাদ করেনি। এই বই স্কুলে তো বটেই, মাদ্রাসায়ও পড়ানো হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষকরাও এর কোন প্রতিবাদ করেনি।

বাংলা বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে হিন্দুয়ানী ও ইসলামবিদ্বেষী গদ্য ও কবিতা, সেগুলো নিয়ে অভিভাবকেরা কোন প্রতিবাদ করেনি। অভিভাবকেরা প্রশ্ন তোলেনি যে, কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কবিতা কেন তাদের সন্তানদের পড়ানো হবে? সিলেবাসে হিন্দুদের কথিত অন্নপূর্ণা দেবীর প্রশংসা ঢোকানো হয়েছে, শিক্ষক-ছাত্ররা কোনরকম টু শব্দ করা ব্যতীত মেনে নিয়েছে। এসব প্রত্যেকটি বিষয় সরকার পরিবর্তন করেছে অনলাইনে লেখালেখি ও এর সূত্র ধরে ইসলামী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের কারণে, জনগণ এখানে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।

যেই মানসিকতার কারণে বাংলা পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুধর্ম চাপিয়ে দেয়াটাকে জনগণ মেনে নিয়েছে, সেই মানসিকতার কারণেই জনগণ মেনে নিয়েছে পদার্থবিজ্ঞান বই থেকে গণিতের সমস্যা বাদ দিয়ে দেওয়াটাকে। এই মানসিকতাকে আমরা জানি ‘অসাম্প্রদায়িক’ মানসিকতা নামে, যেই মানসিকতা আজকে আমাদের সমস্ত প্রতিবাদহীনতার জন্য দায়ী। আমার আগের একটি লেখায় ভারতীয় শিখ লেখক খুশবন্ত সিংয়ের আত্মজীবনী ‘ট্রুথ, লাভ এন্ড এ লিটস ম্যালিস’ বই থেকে একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক শিখ স্বর্ণমন্দিরে হামলার প্রতিবাদে যখন খুশবন্ত সিং তার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি ত্যাগ করল, তখন স্বর্ণমন্দির এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মুসলিম পুলিশ অফিসার তাকে ডেকে বলেছিল,

“আপনি এই সামান্য বিষয়ে এতো ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন কেন?”

খুশবন্ত সিং অবাক হয়ে বলল, “সামান্য বিষয়! আপনি জানেন এই অভিযানে ৫ হাজার শিখ নিহত হয়েছে?”

মুসলিম পুলিশ অফিসারটি বলল, “তাতে কী হয়েছে? হিন্দুরা তো প্রতি বছরই এই পরিমাণ মুসলমান মেরে ফেলছে।”

খুশবন্ত সিং বলল, “আপনাদের মুসলমানদের তো মার খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।”

মুসলিম পুলিশ অফিসারটি বলল, “ইনশাআল্লাহ, শিখদেরও অভ্যাস হয়ে যাবে।”

অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানরা যে এতো নির্যাতনের পরও হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও প্রতিবাদহীন, এর মূল কারণ তাদের ‘অছাম্প্রদায়িকতা’। মূলত মুসলমানদের সমস্ত অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় তার দ্বীনি অনুভূতি দিয়ে। এই অনুভূতিকে যদি মিটিয়ে দেয়া যায়, তাহলেই মুসলমান প্রতিবাদহীন হয়ে যায় এবং তার চোখের সামনে দিয়ে যা খুশি তা-ই করে নেয়া যেতে পারে। তার চোখের সামনে সীমান্তে হত্যা হতে পারে, হিন্দু শিক্ষক মুসলমান ছাত্রীকে রেপ করতে পারে, ভারতের সাথে অস্ত্রচুক্তি হতে পারে, রিজার্ভ পাচার হতে পারে। দেবদেবীর মূর্তিবিশিষ্ট তোরণের নীচ নিয়ে মুসলমানরা ভাবলেশহীনভাবে যেতে পারে কারণ তাদের ‘মুসলমানিত্ব’ই নেই। বাঙালি মুসলমানদের বাঁচার, প্রতিবাদ করার এবং অধিকার আদায় করে নেয়ার একটাই উপায়, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতার ভ্রান্ত পথ পরিত্যাগ করে তাদেরকে ফের মুসলমান হতে হবে।

‘আবার তোরা মুসলমান হ’

Post a Comment

 
Top