প্রতিবছর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে সাধারণত গরুর গোশতের পোলাও প্যাকেট বিতরণ করা হলেও এবার এই আইটেম বাদ দেয়া হচ্ছে। হিন্দুদের কথা মাথায় রেখে এবার মোরগ পোলাও দিয়ে কাউন্সিলর, ডেলিগেট ও অতিথিদের আপ্যায়ন করা হবে। (লিঙ্ক: http://banglamail24.com/news/149392)

এরকমই একটি খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে এসেছে। না আমি আওয়ামী লীগকে আলাদা করে দোষ দিবো না, কারণ এধরণের প্র্যাকটিস সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীষণভাবে লক্ষণীয়। পিকনিকে বা যে কোন আয়োজনে ২-৩ জন হিন্দুর জন্য বাদবাকি ১০০-২০০ জন মুসলমানকে গরুর গোশত থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা এদেশে অহরহ ঘটে থাকে।

যারা এধরণের কাজকে উদারতা হিসেবে সাব্যস্ত করে, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো এটি উদারতা নয় বরং আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড। মুসলমানদের এধরণের হঠকারী কর্মকাণ্ডই উগ্র হিন্দুদের মনোবলকে শক্তিশালী করে, দাদরির মতো ঘটনার ইন্ধন যোগায়। সাথে সাথে নিউইয়র্কে বসে এদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের গরুর জবাই নিষিদ্ধ করার দাবিকেও যেন আমরা ভুলে না যাই। এসবের প্রতিবাদ হতে পারে সর্বক্ষেত্রে গরুর গোশতের আইটেম এড করা।

ইতিহাস বলছে যে, যখনই মুসলমানরা গরুর জবাইয়ের ব্যাপারে দৃঢ় থেকেছে, তখনই তারা সফলতা লাভ করেছে। হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ইতিহাস সকলেই জানে। তিনি সহ আরো অনেক বড় বড় ওলীআল্লাহ গরু জবাইয়ের ব্যাপারে আপোষহীন থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহীর বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি। বিশেষ করে সম্রাট আকবর কর্তৃক গরু কুরবানী নিষিদ্ধ করার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। আকবর সাথে উনার বিরোধিতা থাকলেও আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর পরবর্তীতে উনার অনুগত হন। আনুগত্যতা স্বীকারের পর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরকে স্বহস্তে গরু কুরবানী করতে বাধ্য করেছিলেন।

বিপরীতে মুসলমানরা যখনই হিন্দুদের তুষ্ট করতে গরু কুরবানী থেকে বিরত থেকেছে, তখনই হিন্দুদের দ্বারাই তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। পরাজয় তাদেরকে বরণ করতে হয়েছে। আকবরের বংশেই শেষ মুঘল সম্রাট ছিলো বাহাদুর শাহ জাফর, যাকে ইংরেজরা ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহে উৎখাত করেছিলো। উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল তার ‘দি লাস্ট মোগল’ বইতে উল্লেখ করেছে, এই সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে দিল্লীতে ৫ জন মুসলিম কসাইকে গরু জবাই করার কারণে হত্যা করেছিলো হিন্দু সেপাইরা। এ খবর বাহাদুর শাহ জাফরের নিকট গেলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা তো নেয়া হয়ই না, উল্টো মুসলমানদের গরু জবাই নিষিদ্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এমনকি মুসলমান কাবাব ব্যবসায়ীদেরকে পর্যন্ত ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সে বছর কুরবানীর ঈদে গরু কুরবানী ছিলো একদমই বন্ধ।। এ নিয়ে ব্রিটিশরা তখন ঠাট্টা করেছিলো যে, হিন্দুদের তুষ্ট করতে গিয়ে যদি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে গৌণ করে ফেলে, তবে তারা কখনোই ব্রিটিশবিরোধী জিহাদে সফলতা অর্জন করতে পারবে না।

পরবর্তীতে ব্রিটিশদের কথাই বাস্তবে পরিণত হয়। কারণ যতোই হিন্দুদের তোয়াজ করুক না কেন, হিন্দু তো কখনোই মুসলমানদের বন্ধু হবে না। যুদ্ধের পর দিল্লীতে মুসলমানদের বাড়িঘর সমস্তকিছু ব্রিটিশরা হিন্দুদেরকে দিয়ে দিয়েছিলো, যার ফলে মুসলিমপ্রধান দিল্লী রাতারাতি হিন্দুপ্রধান শহরে পরিণত হয়েছিলো। মুসলমানদের বহু লাইব্রেরী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো দিল্লীতে,যে শহরটি ছিলো ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র। তার সবই হিন্দুরা ধ্বংস করে ফেলে। (এ নিয়ে আমার পূর্ববর্তী পোস্ট: https://goo.gl/zBy0Yz)

এরকম উদাহরণ অতীত ইতিহাসে আরো রয়েছে। খিলাফত আন্দোলনের নেতা মুহম্মদ আলী গান্ধীকে তুষ্ট করতে গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়। তার আশা ছিলো, গরু জবাই ত্যাগ করলে হিন্দুরা মুসলমানদের সাথে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো, গান্ধী এই অবস্থাকে পুঁজি করে ‘গো-রক্ষা’কারী নেতা তথা উগ্র হিন্দুনেতা হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হলো। গান্ধী ঘোষণা দিলো-

“আমি নিজেকে প্রাচীনপন্থী সনাতন হিন্দু বলি যেহেতু (ক) আমি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্র বলে যাহা কিছু বোঝায় অর্থাৎ অবতার বাদ ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি, (খ) বেদের বিধানসম্মত বর্ণাশ্রম ধর্ম আমি বিশ্বাস করি, (গ) প্রচলিত অর্থে নয়, বরং বৃহত্তর অর্থে আমি গো-রক্ষানীতি সমর্থন করি, (ঘ) মূর্তি পূজায় আমার অবিশ্বাস নেই।”

হিন্দুরা দাঁড়াতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়। অর্থাৎ গরু নিয়ে আপস করলে কথিত ‘সম্প্রীতি’ তো বাড়বেই না, বরং হিন্দুরা আরো সুযোগ পেয়ে মুসলমানদের ঘাড়ের উপর চড়ে বসবে। ইতিহাস বারবার সেটাই প্রমাণ করেছে। মূলত মুসলমানদের স্বকীয়তা ধরে রাখাটাই তার সম্মান ও মর্যাদা টিকিয়ে রাখার মূল চাবিকাঠি। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রদ্বিআল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি জেরুজালেম বিজয় করেছিলেন, যাওয়ার পথে ভৃত্যকে উটের পিঠে বসিয়ে নিজে উটের রশি ধরেছিলেন। এই ইতিহাস আমরা সবাই জানি। সেই জেরুজালেমে গিয়ে যখন খ্রিস্টানদের নিকট থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের চাবি তিনি গ্রহণ করবেন, তখন খ্রিস্টানরা উনার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করার অনুমতি প্রার্থনা করে। তিনি অনুমতি প্রদান করেন।

খাওয়ার সময়ে হযরত উমর রদ্বিআল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্লেট মুবারক থেকে কিছু রুটির টুকরা দস্তরখানে পড়ে গিয়েছিলো। সেগুলো তিনি তুলে তুলে খাচ্ছিলেন। এ বিষয়টি দেখে কেউ কেউ বললো, হে আমীরুল মু’মিনীন। এখানে তো খ্রিস্টানদের অনেক কথিত গণ্যমান্য ব্যক্তি রয়েছে। তাদের সামনে এভাবে দস্তরখান থেকে রুটি তুলে না খেলে হতো না?

তা শুনে হযরত উমর রদ্বিআল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন, এই আহমকগুলোর জন্য আমি আমার রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত ছেড়ে দিবো! এই আহমক কাফির খ্রিস্টানগুলোর জন্য!

এ কারণেই উনারা প্রত্যেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছিলেন, যেহেতু উনারা কখনোই কাফিরদের তোয়াজ করতে গিয়ে মুসলমান হিসেবে নিজের স্বকীয়তা বর্জন করেননি। আর আওয়ামী লীগের গরুর গোশত বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বলবো, ইতিহাসের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এতোদিন আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিলো প্রতিবছর তাদের কাউন্সিলে গরুর গোশত রাখার উসিলাতেই। সেই গরুর গোশত যখন তারা বাদ দিলো, তখন তাদের জন্য অচিরেই বড় ধরণের লাঞ্ছনা ও পরাজয় অপেক্ষা করছে, এটা আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।

Post a Comment

 
Top