আচ্ছা পাঠকেরা, আপনারা নিশ্চয়ই শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ঐ লাইনটির কথা শুনেছেন যে, “আজ বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল খেলা হবে”। এই লাইনে কী বোঝানো হয়েছে তাও সবাই জানেন। কলকাতার হিন্দুরা মুসলমানদেরকে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করতে চায় না, তারা ‘বাঙালি’ বলতে কেবলই বাংলাভাষী হিন্দুদেরকে বোঝায়।

হিন্দু লেখক-কবিদের এরকম বহু বহু লাইন রয়েছে, যেখানে ‘বাঙালি’ বলতে নির্দিষ্টভাবে কেবল বাংলাভাষী হিন্দুদেরকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন প্রাবন্ধিক নীরদ সি চৌধুরীর একটি মন্তব্য হলো-

“বাঙালি পুরুষ ইংরেজ রাজত্বের আগে একমাত্র মুসলমান নবাবের কর্মচারী হইলে মুসলমানী পোষাক পরিত, উহা অন্দরে লইয়া যাওয়া হইত না।” (আত্মঘাতী বাঙালী, নীরদ সি চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৫০)

এখানে ‘বাঙালি পুরুষ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? বোঝানো হয়েছে নিঃসন্দেহে হিন্দুদেরকে। এখন আফসোসের বিষয় হলো, হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের ঐসব ‘বাঙালি’ উল্লেখকারী লাইনগুলো, যা একান্তই হিন্দুদের উদ্দেশ্যে রচিত, সেগুলো মুসলমানরা না বুঝেই নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। যেমন রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য-

“রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি”

এই লাইনটা অহরহ এদেশের মুসলমানরা নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। এদের কারো ধারণাই নেই যে, রবীন্দ্রনাথ কেন, কোন উদ্দেশ্যে এই মন্তব্যটি করেছিলো।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা অনেকেই শুনেছেন। সেই বঙ্গভঙ্গের সময়ে এদেশে হিন্দু সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটে, যার একজন প্রধান নেতা ছিলো রবীন্দ্রনাথ নিজেই। সে সময়ে রবীন্দ্র ‘শিবাজি উৎসব’ এর মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী কবিতা লিখে হিন্দুদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় উৎসাহিত করেছিলো।

এখন বিষয়টি হলো, বঙ্গভঙ্গ হয়েছিলো বাংলাকে কেন্দ্র করে, আর এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী হিন্দু সন্ত্রাসী যুবকেরা সকলেই ছিলো বাংলাভাষী। এই বাংলাভাষী হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের প্রণোদনা দিতে ব্যবহার করতে হতো মারাঠা কিংবা রাজপুতদের কাহিনী।কারণ বাংলাভাষী হিন্দুদের নিজস্ব কোন বীরত্বের কাহিনী কখনোই ছিলো না। বাংলার মুসলমানদের যেমন বখতিয়ার খিলজী, সুলতানী আমল, ঈশা খাঁর ইতিহাস রয়েছে, বাংলার হিন্দুদের তেমনটি নেই। তাই ঘুরেফিরে সেই রাজপুত আর মারাঠাদের কাহিনীই ব্যবহার করতে হতো এদেশের হিন্দুদেরকে।

এ কারণে আস্তে আস্তে এই বিষয়টি প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যে, বাংলাভাষী হিন্দুরা মারাঠা কিংবা রাজপুতদের তুলনায় একান্তই হীন। তারপরও ভারতের অন্য সমস্ত হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপরে বাংলাভাষী হিন্দুদের প্রাধান্য ছিলো, কারণ তারা ছিলো ব্রিটিশদের এক নম্বর দালাল। সবচেয়ে কাছের লোক হিসেবে ব্রিটিশরা বাংলাভাষী হিন্দুদের শহর কলকাতাকে ১৫৫ বছর ধরে গোটা উপমহাদেশের রাজধানীর মর্যাদা প্রদান করে রেখেছিলো।

কিন্তু ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের সাথে সাথে ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে সরিয়ে নেয়। অবধারিতভাবে তখন ভারতে হিন্দীভাষীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাভাষী হিন্দুরা তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত হতে শুরু করে। কারণ একে তো বীরত্বের কোন ইতিহাস নেই, তার ওপর রাজধানীর মর্যাদাও তারা হারিয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পায়। তখন তারা বিভিন্নভাবে নিজেদের হীন অবস্থানকে তাদের লেখায় ফুটিয়ে তুলতে শুরু করে। যেমন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলো-

“বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল — বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে”

এখানে যা বলা হয়েছে, তা হলো ‘বাঙালী’ তথা হিন্দুদের বল বা বিক্রম নাই, অর্থাৎ তাদেরকে বল বা বিক্রমের উদাহরণ দিতে হলে রাজপুত কিংবা মারাঠার শরণাপন্ন হতে হয়। সাথে সাথে আরও বলা হয়েছে

“বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে”

অর্থাৎ বাংলাভাষী হিন্দুরা যে ব্রিটিশদের নিকট থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলো একটি সময়ে, তা ছিলো ‘তৈলের জোরে’। বাংলাভাষী হিন্দুদের বিশেষ ব্যক্তি যারা, বঙ্কিম হোক, রামমোহন রায় হোক, সকলের উন্নতির মূল সূত্র ছিলো ব্রিটিশদের ‘তৈল’ দেয়া। সত্যিকার অর্থে বলতে হলে, এই ব্রিটিশদের গোলামি করা ছাড়া বাংলাভাষী হিন্দুদের গর্ব করার মতো ইতিহাসে আর কিছুই নেই।

এ কারণেই রবীন্দ্র বলেছিলো-

“রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি”

অর্থাৎ সোজা অর্থে বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী হিন্দু হয়ে জন্মানোর জন্যই তার কবিতায় আক্ষেপ করেছে। তার চোখে বাংলাভাষী হিন্দুরা মানুষ নয়, মানুষ হলো মারাঠা বর্গী দস্যুরা। যদি ‘বাঙালি’ হওয়ার বদলে সে তার স্বপ্নের রাজপুত কিংবা মারাঠা বর্গী দস্যু হয়ে জন্মাতে পারতো, তাহলে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ঘুঁচতো। বলা বাহুল্য, এরূপ মনোভাব থেকেই রবীন্দ্রনাথ ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলো, বাংলার পক্ষে নয়। বস্তুত, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে রবীন্দ্রর উপরিউক্ত উক্তিটিকে নিম্নরূপে লেখা যেতে পারে-

“রেখেছ হিন্দু করে, মানুষ করোনি।”

Post a Comment

 
Top