বাঙালি মুসলমানকে এখন জুজুর ভয় দেখানোর মতো লোকের অভাব নেই। মিয়ানমারের হেলিকপ্টারকে গুলি করলে বাংলাদেশের এই হবে সেই হবে, এসব ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে রীতিমতো তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে পিনাকীর মতো রিভার্স হিন্দুত্ববাদীদের মাইন্ড গেম, “দস্তার রাজদরবার-নয়ন চ্যাটার্জি এরা বিজেপির এজেন্ট! আপনারা কেউ তাদের দেখাদেখি হিন্দুদের বিরোধিতা করবেন না। হিন্দুদের বিরোধিতা করলেই বিজেপি সুযোগ পাবে, তখন আপনাদের খবর করা হবে!”

আসলেই কি পিনাকীর কথানুযায়ী হিন্দুদের বিরোধিতা করলে বিজেপি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায়? কারণ আমরা যতো দৃশ্যমান বিজেপির এজেন্ট দেখি, সবার মূলনীতি হলো ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ কোন বিজেপির এজেন্টকে দেখানো যাবে না, যে কিনা মুসলমানদেরকে হিন্দুদের ব্যাপারে সাবধান করছে।

মূলত বিজেপির মূল অস্ত্রই হলো মুসলমানদের অন্তরে বাসা বাঁধা হিন্দুপ্রেম। পাশ্ববর্তী দেশে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল একটি মাত্র রাজ্যকে কেন্দ্র করে, আর তা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ। মোদি ক্ষমতায় আসার মূল কারণ হলো উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয় এবং উক্ত এলাকার অমিত শাহের ভূমিকা। যে কারণে ২০১৪ সালে মোদি নির্বাচনে জয়ের পরই অমিত শাহকে তার ডানহাতে পরিণত করেছিল। এই উত্তরপ্রদেশে কি তখন হিন্দুবিদ্বেষ প্রচার করা হয়েছিল? ভারতীয় মিডিয়ার খবরগুলো এখনও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, আপনারা একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন যে বিজেপি নির্বাচিত হওয়ার বছর কয়েক আগে থেকেই উত্তরপ্রদেশে হিন্দুপ্রেমের জোয়ার বয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ-

১) বিজেপির অন্যতম শক্তি রামদেব-রবিশঙ্করের মতো ভারতের হিন্দু ধর্মগুরুরা। এই ধর্মগুরুদের প্রত্যেককেই উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দে বছরের পর বছর প্রধান অতিথি করে আনা হতো। রামদেব দেওবন্দে প্রধান অতিথি হয়ে এও বলে এসেছিল যে, নামাযের সাথে হিন্দুদের যোগব্যায়ামের কোন তফাৎ নেই।

২) গরু জবাইয়ের কারণে মানুষ মেরে ফেলায় অনেকেই ভারতীয় হিন্দুদের প্রতি ক্ষুব্ধ। কিন্তু জানেন কী, এই দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর ফতোয়া দেয়া হতো যে, আপনারা গরু কুরবানী করবেন না, কারণ গরু হিন্দুদের দেবতা।

৩) ২০১১ সালে রাশিয়ায় একবার গীতা নিষিদ্ধ হয়েছিল। সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। দেওবন্দ থেকে বলা হয়, গীতার পক্ষে হিন্দু মুসলমান সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বলা বাহুল্য, দেওবন্দ মাদ্রাসার বড় হুজুর যদি গেরুয়া পোষাকপরা রামদেবের সাথে মাখামাখি করে, গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে বলে, গীতার পক্ষে দাঁড়াতে বলে, সেক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের মুসলমানরা কেন বিজেপিকে ভোট দেবে না বলুন? এটি আমরা সবাই জানি যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের মুসলমানরাই। বিভিন্ন মিডিয়া ও সংস্থার রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছিল।

মুসলমানদের বুঝতে হবে যে, হিন্দু-মিয়ানমার এরা আসলে জুতা দিয়ে পুছারও উপযুক্ত নয়। মিয়ানমার ইতিমধ্যেই তার দেশে শত শত বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যদি সাহস করে একবার অগ্রসর হয়, তারা প্রায় বিনাযুদ্ধে আরাকান দখল করে নিতে পারে। এই বিষয়টি দালালেরা বোঝে, তাই ভয় দেখিয়ে জাতিকে দমিয়ে রাখতে পত্রিকায় বড় করে মিয়ানমারের কথিত সামরিক সক্ষমতার ভুয়া রিপোর্ট ছাপা হয়।

সাতচল্লিশের আগে এই ভারতবর্ষে কেবল বাঙালি মুসলমানরাই সত্যিকার অর্থে পাকিস্তান চেয়েছিল, আর কেউই কিন্তু তা এতো স্পষ্টভাবে চায়নি। উল্লেখ্য, সাতচল্লিশের আগে এই বাঙালি মুসলমানই ছিল গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে গরীব ও শিক্ষাবঞ্চিত। কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামক আইনের দ্বারা এই অঞ্চলের মুসলমানদের জমি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের দেয়া হয়েছিল, যা ভারতের অন্যান্য জায়গায় হয়নি। যে কারণে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ ভারতের সব এলাকায় মুসলমানরা ছিল অগ্রসর জনগোষ্ঠী, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছিল না।

মজার বিষয় হলো, উত্তরপ্রদেশ আর পাঞ্জাবের ধনী ‍মুসলমানদের একটি বড় অংশই ছিল হিন্দুস্তানের পক্ষে, কারণ তারা তখনও হিন্দুদের দাঁতনখ দেখেনি। মূল স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই শিক্ষাবঞ্চিত বাঙালি মুসলমানরা তখন হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারপরও কিন্তু তারা পাকিস্তান পেয়েছিল। তৎকালীন সময়ে বাঙালি মুসলমান সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার পরও কেবল হিন্দুবিদ্বেষের জোরে যদি এতোটা সফলতা অর্জন করতে পারে, সেক্ষেত্রে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমানরা হিন্দুবিদ্বেষী হলে কি না করতে পারে বলুন?

পিনাকীরা এই ক্যালকুলেশন ভালোভাবেই জানে, তাই সে বিজেপির জুজুর ভয় দেখিয়ে বাঙালি মুসলমানকে দমিয়ে রাখতে চায়, ভারতের নপুংসক মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতো বাঙালি মুসলমানদেরকেও হিন্দুপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চায়। এ কারণে পিনাকীকে নিয়ে রমনা কালী মন্দিরের সভাপতি দয়াময় বিশ্বাস দীপু মন্তব্য করেছিল, “শুধু জেনে রাখুন পিনাকি ভট্টাচার্য সবার থেকে বড় হিন্দু। আপনারা যা পারছেন না উনি তা প্রায় পেরে গেছেন।” সেই পারাটা হচ্ছে মুসলমানের অন্তরে প্রীতির আসন দখল করা।

হিন্দুদের সবচেয়ে বড় সফলতা কি জানেন? তা হলো মুসলমানকে এই বুঝ দেয়া যে, হিন্দুরা হচ্ছে গিয়ে তাদের বন্ধু, তাদের শুভাকাঙ্খী।  কারণ মুসলমান যখনই হিন্দুদের প্রতি দুর্বল হয়, তখনই হিন্দুরা আঘাত করার সুযোগ নেয়। ভারতে বিজেপি যতো দাঙ্গা করে, সব জায়গায় মুসলমানরা একই কথা বলে, আমি আমার পাশের বাসার অমুককে ভাই ডাকতাম, অমুককে ছেলে ডাকতাম, অথচ সে এসে আমাকে রেপ করে দিল! বোকা মুসলমানরা বোঝে না, ঐ হিন্দুটা তক্কে তক্কে ছিল, কতোক্ষণে তুমি তাকে ভাই ডাকবে, ছেলে ডাকবে আর সে তোমার অসাবধানতার সুযোগে তোমার সর্বনাশ করতে পারবে।

Post a Comment

 
Top