কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। (লিঙ্ক:https://youtu.be/rLbrPq4-UwA) ভিডিওটি তৈরী করেছেন চাকরিক্ষেত্রে হিন্দুদের দ্বারা অপদস্থ হওয়া এক মুসলমান। সেই ভিডিওতে বক্তা প্রথমেই বলেছিলেন-
“মুসলমানরা যখন কোন হিন্দুকে চাকরি দেয় কিংবা ব্যবসায় ডিল করে, তখন সে হিন্দুটিকে আর দশটা মানুষের মতোই মনে করে। কিন্তু বিপরীতে একটা হিন্দু যখন মুসলমানের মুখোমুখি হয়, তখন সে মুসলমান ব্যক্তিটিকে ধরে নেয় তার শত্রু হিসেবে।”
অর্থাৎ মুসলমানরা হিন্দুদেরকে আর দশটা মানুষের ন্যায় গণ্য করে বলেই হিন্দুদের হাতে ব্যবসা চাকরি চলে গেলেও তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। বিপরীতে মুসলমানদের এই ধারণাও নেই যে, তার পাশের হিন্দুটা তাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। যার ফলে হিন্দুদের হাতে চাকরি-ব্যবসার দখল চলে গেলে ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কেও বাংলাদেশের মুসলমানদের কোন ধারণা নেই। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের গায়ক কবীর সুমনের একটি স্ট্যাটাসের কথা তুলে ধরবো, যা তিনি আজকে শেয়ার করেছেন।
কবীর সুমনের বাবা সুধীন্দ্রনাথ ছিলো কলকাতা রেডিওর কর্মী। সুধীন্দ্রনাথের কলিগ ছিলো শামসুল হুদা চৌধুরী, যে পরবর্তীতে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ও স্পীকার হয়েছিলেন।১৯৩৭ এ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি জয়ী হলে কলকাতায় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসে। যার ফলে কলকাতায় তখন মুসলমানদের একটি উন্নত অবস্থার সৃষ্টি হয়, শামসুল হুদা চৌধুরীর মতো অনেক মুসলমান চাকরিতে উঠে আসে। পরবর্তীতে ৪৭ এ দেশভাগ হলে কলকাতায় মুসলিম সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু তারপরও শামসুল হুদা চৌধুরী কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন, কারণ তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। এ প্রসঙ্গে কবীর সুমন লিখেছেন-
//দেশ ভাগের সময়ে কলকাতা রেডিও’র মুসলমান কর্মীদের তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গিয়ে রেডিও পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। একমাত্র হুদা সাহেব যেতে চাননি। ভারতেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।
সুধীন: বুঝলি, বছর দুই তিনের মধ্যেই হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে টের পেয়ে গেলাম পুরোপুরি। হুদাকে উঠতে বসতে অপমান করতে লাগলো যে হিন্দু সহকর্মীরা - সকলেই বাঙ্গালি ভদ্রলোক - তাদের স্বরূপ যে এমন তা দেশভাগের আগে জানতে পারিনি। আমি হুদার বন্ধু ছিলাম, পারিবারিকভাবেও বন্ধু ছিলাম আমরা, হুদার স্ত্রী তোর মায়ের বন্ধু ছিলেন, তা আমি হুদার বন্ধু তাই আমাকেও ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা বলতে লাগলো অনেকে। আশ্চর্য, আর কেউ হুদার পাশে এসে দাঁড়ালো না। হুদা কিন্তু হাসি মুখে সব সহ্য করতো। আমি রেগে যেতাম। হুদা আমায় ঠাণ্ডা করতো।
... কিন্তু আমিই একদিন ওকে বললাম, হুদা, তোমার এই অপমান তো নিতে পারছি না আর। বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছিলাম আমি। তার কিছুদিন পরে হুদা আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলল - আমি আর পারছি না। কবে যে কী করে বসব। তার চেয়ে ঢাকায় চলে যাই। ওটা আমার কাছে ‘দেশ’ না। আমার দেশ এখানে। আমি বীরভূমের ছেলে। কলকাতায় বড় হয়েছি। কিন্তু ঢাকাতেই মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি, কী করবো। - সুধীনও মেনে নিলো অগত্যা// (স্ট্যাটাস লিঙ্ক:https://goo.gl/pWcD3B)
পাঠকেরা একটি বিষয় খেয়াল করুন। দেশভাগের আগে যখন কলকাতায় মুসলিম সরকার ক্ষমতায় ছিলো, তখন হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবটি কেউই ধরতে পারেনি। কিন্তু যখনই দেশবিভাগ হলো আর সরকার পরিবর্তন হয়ে হিন্দুরা কলকাতার ক্ষমতায় আসলো, সাথে সাথে হিন্দু কলিগেরা শামসুল হুদা চৌধুরীর সাথে অভাবনীয় দুর্ব্যবহার শুরু করে দিলো। যার কারণে বাধ্য হলে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে শামসুল হুদা চৌধুরীকে আসতে হলো বাংলাদেশে।
ঠিক সেভাবেই যদি বর্তমানে বাংলাদেশেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে, যদি হিন্দুরা কলকাতার ন্যায় বাংলাদেশেরও সবকিছুর দখল নিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী হতে পারে? তখন বাংলাদেশের মুসলমানদেরও কিন্তু দেশ ছাড়ার উপক্রম হবে হিন্দুদের অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে, যেসব হিন্দুরা এখন গোবেচারা ভালোমানুষ সেজে আমাদেরই পাশে অবস্থান করছে। তবে শামসুল হুদা চৌধুরীর কিন্তু কলকাতা ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসার একটা সুযোগ ছিলো, কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানরা বাংলাদেশ ত্যাগ করে কই যাবে? বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরা ছাড়া তখন তাদের সামনে আর কোন উপায়ই থাকবে না।

Post a Comment

 
Top