ফেসবুকে এক কথিত ইসলামিস্ট নাকি নাস্তিকে পরিণত হয়েছে, যার মানুষ ডাকে ‘মোফা পাগলা’ বলে। অনেকে বিষয়টি নিয়ে চুচেরা বিশ্লেষণ করছে, কেন মোফা পাগলা নাস্তিক হলো কী করে হলো ইত্যাদি। তবে আমি বিষয়টি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, কারণ সে আগে থেকেই নাস্তিক ছিলো। তার আগে থেকেই ইসলাম নিয়ে হীনম্মন্যতা ছিলো।
সে এক স্ট্যাটাসে ব্রিটেনে বসবাস করা নিয়ে খুব গর্ব করেছিলো। আরেকটি স্ট্যাটাসে সে লিখেছিলো, মুসলমান বাদশাহরা সব অত্যাচারী ও যুদ্ধবাজ। এধরণের ধারণা অনেকের মধ্যেই রয়েছে, আর এখান থেকেই মুসলিম সমাজে নাস্তিকতার উৎপত্তি।
এর কারণ, আমাদের দেশে ইসলামের ইতিহাসকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না। এটা উপস্থাপন করা হয় না যে, আমরা বর্তমানে যে অফিস-আদালত দেখি, যে বিচারব্যবস্থা দেখি, প্রশাসন পরিচালনা দেখি, রাজস্ব আদায়ের নিয়ম দেখি, সেগুলো প্রত্যেকটিই এসেছে স্পেসিফিক্যালি ভারতবর্ষের মুসলিম সভ্যতা থেকে।
ক্লাইভের ‘দ্বৈত শাসন’ ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকেই শুনেছেন। এই শাসনব্যবস্থা ছিলো এরকম যে, মুসলমানরা সব অফিস-আদালত, বিচারব্যবস্থা, রাজস্ব আদায় এগুলো পরিচালনা করবে, আর ইংরেজরা টাকাপয়সা যা লাভ হয় তা নিয়ে নিবে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই শাসনব্যবস্থা করছিলো ব্রিটিশরা? এর কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিজস্ব কোন শাসনব্যবস্থার নিয়মকানুন জানা ছিলো না। এই সময়টিতে অফিসার নিয়োগ হতো মাদরাসা শিক্ষার উপর ভিত্তি করে। এ সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার লিখেছিলো,
“এই ব্যবস্থা (মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা) ভারতে সে সময়ের অন্য যে কোনও বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় বহুগুণে উন্নত ছিলো। এই ব্যবস্থায় তাঁরা (মুসলমানরা) এক বুদ্ধিগত ও বৈষয়িক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছিলেন এবং কেবলমাত্র এর সাহায্যেই হিন্দুরা তাদের নিজেদের দেশে কর্তৃত্বের একটি ন্যূনতম অংশ পাবার উপযুক্ত হয়ে উঠার আশা করতে পারতো। আমাদের শাসনের প্রথম ৭৫ বছর আমরা প্রশাসন ও পরিচালনার জন্য অফিসার তৈরি করার উপায় হিসাবে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগাচ্ছিলাম।” (তথ্যসূত্র: দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১২৪)
এখানে শাসনব্যবস্থার প্রথম পঁচাত্তর বছর অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত সময়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষার প্রচলন করে। মুসলমানরা তা গ্রহণ করতে চায়নি। কেন চায়নি তার বহু কারণ রয়েছে। এর একটি কারণ উইলিয়াম হান্টারই বলে দিয়েছে, তা হলো মুসলমানরা এই শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন।
কেমন ছিলো সেই শ্রেষ্ঠত্ব, তার উদাহরণ দিতে আমি ইংলিশ মিডিয়ামের কথা উল্লেখ করবো। মানুষ এখন ইংলিশ মিডিয়ামে নিজের বাচ্চাদেরকে পড়ানোর ইচ্ছা রাখে, ইংলিশে বুলি ছাড়ার চেষ্টা করে। ভাবে এরকম করলে সে জাতে উঠতে পারবে। ঠিক সেভাবেই ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকেও যখন মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো, তখন হিন্দু ও খ্রিস্টানরা মুসলমানদের মতো পোষাক পরে, মুসলমানদের ফারসী ভাষা শিখে জাতে উঠতে চাইতো।
ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই মুসলিম শাসনামলে হিন্দু কর্মচারীদের কথা শুনে থাকবে। তবে এই ধারণা হয়তো অনেকেরই নেই যে, ঐসব হিন্দু কর্মচারীরা ধুতি নেংটি পরা হিন্দু ছিলো না। ঐসব হিন্দুরা ছিলো মুসলমানদের মতো পোষাক পরা, মুসলমানদের ভাষায় কথা বলা হিন্দু। এ প্রসঙ্গে নীরদ সি চৌধুরীর বক্তব্য-
“তখনকার দিনে উচ্চ শ্রেণীর বাঙালি হিন্দুর বাহ্যিক রূপ ও আচরণ প্রায় মুসলমান আমিরদের মতো হইতো। তাহাদের কেহ কেহ মুসলমান রায় নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হইতো। অন্য ভদ্র হিন্দুরা নবাবী শাসন-ব্যবস্থায় নিম্নতর কর্মচারী হইােত, তাহাদের উপাধি সাধারণত মজুমদার, সরকার, তালুকদার, কারকুন, কানুনগো, মল্লিক ইত্যাদি হইতো।
এ কারণেই মুসলমানদের বলা হতো শাসক জাতি, কারণ অন্যান্য জাতিরা তাদেরই অনুকরণ করতো। এই যে উচ্চতর শ্রেণীর হিন্দুদের কথা বলা হয়েছে, তারা ছিলো ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, মুসলমানদের অধীনে ফারসী শিক্ষাগ্রহণ ও কেরাণীগিরি হওয়ার কারণেই আজ ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা হিন্দুসমাজে শূদ্রদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শূদ্ররা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানবিজ্ঞানকে গ্রহণ করেনি। যদি করতো, তাহলে আজ ব্রা্হ্মণরা নিচুবর্ণ হতো, শূদ্ররা হতো উচুবর্ণ।
এখনকার দিনে মানুষ জানে না, মুসলমান বলতে তখন কোন স্টেজের মানুষদেরকে বোঝানো হতো? ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকে মুসলমানরাই যে অফিস আদালত সব চালাতো, তার প্রমাণ হিসেবে সে সময়ে মুসলিম কর্মকর্তাদের লিস্ট তুলে ধরেছেন ড. ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবী’ নামক গ্রন্থে। বইটির কয়েকটি পাতার পিডিএফ লিঙ্ক-https://goo.gl/i34mKv
এখনকার মানুষ মনে করে, মুসলমানরা খালি যুদ্ধই করেছে। এ কারণেই মোফা পাগলা আর মগাচীপের মতো হীনম্মন্যতায় ভোগা লোকেরা নাস্তিক হয়। যাই হোক, মোফা পাগলা অনেক ভুল সময়ে তার রাস্তা বেছে নিয়েছে। কারণ আমেরিকা-ইউরোপের দম এখন শেষ পর্যায়ে। গ্রিসের মতো দেশের খ্রিস্টান মেয়েরা এখন স্যান্ডউইচের জন্য রাস্তায় রাস্তায় বেশ্যাবৃত্তি করে। আর আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছে, তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশ্রী বুদবুদের উপর, যে কোন সময়ে তাদের অর্থনীতির পতন অনিবার্য। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা এতো খারাপ, যে সেখানকার কলকারখানা-গাড়িঘোড়া সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যার ফলে সৌদি তেলের যে চাহিদা আগে ছিলো, তা এখন আর নেই। আগে ১৫০ ডলারে যে অশোধিত তেলের ব্যারেল বিক্রি হতো, তার দাম এখন ৩০-৪০ ডলারও নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোর এই বিশ্রী বুদবুদকে এখন অবলম্বন করেছে মোফা পাগলা আর মগাচীপেরা। তবে লাভ হবে না, পশ্চিমাদের পতন অনিবার্য। আর ভারতীয় হিন্দুরা তো পথেঘাটে কুকুরের মতো হেগে বেড়ায়। আসলে এখন মুসলমানদের যা করা দরকার, তা হলো তওবা-ইস্তেগফার করা। মুসলমানরাও তো মোফা পাগলার মতো নিজেদের ধর্ম ও জাতির ইতিহাস না জানার কারণে হীনম্মন্যতায় ভুগে থাকে, সুতরাং তাদের উচিত এসব থেকে তওবা করে গর্বিত মুসলমান হওয়া। তা হলে কাফিরদের বিশ্রী বুদবুদের পতন আরো তরান্বিত হবে আর মোফা পাগলার মতো পল্টিবাজ মুনাফিকেরা অচিরেই রাস্তায় ফুটা থালা হাতে বসতে বাধ্য হবে।

Post a Comment

 
Top