আয়া সুফিয়াকে এরদোয়ান কেন মসজিদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিলেন, এর উত্তর এককথায় এটাই হতে পারে যে, সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ যে কারণে আয়া সুফিয়াকে মসজিদ করেছিলেন, সে কারণেই এরদোয়ান ফের আয়া সুফিয়াকে মসজিদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর কারণটি হলো, খ্রিস্টধর্মের দুটি প্রধান শাখা-ক্যাথলিক ও অর্থোডক্সদের মধ্যে মিটমাটের ষড়যন্ত্রে বাধাপ্রদান ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যৌথ ক্রুসেড প্রতিহত করণ।

ইতিহাসের পাতায় আমরা যেসব ক্রুসেডের উল্লেখ পাই, তার সবগুলো হয়েছে ভ্যাটিকান কেন্দ্রিক ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের দ্বারা। বাইজান্টাইন বা কনস্টান্টিনোপল কেন্দ্রিক যে গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম, তার দ্বারা কোনো ক্রুসেড ঘোষিত হয়নি। ইতিহাসের পাতায় ৪র্থ ক্রুসেডের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা মুসলমানদের আক্রমণ করার নিয়তে বের হলেও শেষপর্যন্ত যুদ্ধটি পরিচালিত হয় বাইজান্টাইন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপর, যাতে কনস্টান্টিনোপল শহরটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

এছাড়াও ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে বিশ্বাসগত অনেক পার্থক্য রয়েছে, যে কারণে বাস্তবে এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্ম বলে উল্লেখ করা চলে। বিশ্বাসগত পার্থক্যের সাথে ৪র্থ ক্রুসেডে ক্যাথলিকদের ব্যাপক যুলুম-নির্যাতন, সবকিছু মিলিয়ে ক্যাথলিক ও অর্থোডক্সদের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী বিভেদ রয়েছে, যাকে বলা হয় east-west schism বা পূর্ব-পশ্চিম বিভেদ। এই বিভেদ দূর করে খ্রিস্টধর্মের দুটি শাখাকে মিলিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যৌথ ক্রুসেড পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৪৩১ থেকে ১৪৪৯ সালের মধ্যে, যাকে বলা হয় Council of Florence.

উক্ত কাউন্সিলে তৎকালীন কনস্টান্টিনোপলের শাসক john VIII Palaiologos এর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা তাদের নিজস্ব আক্বীদাকে ত্যাগ করে ভ্যাটিকানের আক্বীদাকে মেনে নিবে, তথা তারা ক্যাথলিক হয়ে যাবে এবং এর বিনিময়ে ক্যাথলিকরা কনস্টান্টিনোপল শহরটির চতুর্পাশে রাজত্বকারী উসমানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।

সে অনুসারে 10 November 1444 সালে Battle of Varna তে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, মলদোভা সহ কয়েকটি দেশ একত্রে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করে, যাতে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এরপর সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেন। শহরটি দখলে নিয়ে তিনি যা করেন, তা হলো অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে যে দলটি ভ্যাটিকানের আক্বীদাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তাদেরকে তিনি অর্থোডক্স চার্চের নেতৃত্বে বসিয়ে দেন।

ফলশ্রুতিতে অর্থোডক্স ও ক্যাথলিক চার্চের মধ্যকার যে মিটমাটের সম্ভাবনা, তা দূরীভূত হয়। খ্রিস্টানদের যৌথ ক্রুসেডের আশাও ধুলিসাৎ হয়। সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের নেতৃত্ব পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের যে প্রধান স্থাপনা তথা আয়া সুফিয়া, সেটিকেও পরিবর্তন করে মসজিদে পরিণত করেন। করাটাই ছিল স্বাভাবিক।

কারণ প্রধান স্থাপনা দখলে থাকলে তাদের মধ্যে স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের মনস্তত্ব কাজ করবে, যে বিদ্রোহ দমন করতেই সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চে ভ্যাটিকান বিরোধী নেতৃত্বকে বসিয়েছিলেন। বর্তমানেও সেই একই প্রক্রিয়া চলছে, ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ফ্রান্সিস ও ইস্তাম্বুলে অর্থোডক্স চার্চের প্রধান বার্থোলোমিউ, যৌথ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে east-west schism দূরীভূত করে ফের যৌথ ক্রুসেড পরিচালনা করতে।

অনেকেই জানে না, এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় শত্রুদের একজন হচ্ছে এই ইস্তাম্বুল অর্থোডক্স চার্চের প্রধান বার্থোলোমিউ, যার সাথে রয়েছে তুরস্কের সেনা বিদ্রোহের ইন্ধনদাতা গুলেন পার্টির ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ভ্যাটিকানের ফ্রান্সিস, ইস্তাম্বুলের বার্থোলোমিউ, গুলেন পার্টি এরা আন্তর্জাতিকভাবে ডেমোক্রেট ব্লকের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িত। বিশেষ করে বার্থোলোমিউকে খেতাব দেয়া হয়েছে ‘গ্রীন প্যাট্রিয়ার্ক’, ডেমোক্রেটদের পরিবেশবাদী আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য। ওবামার আমলে এই ডেমোক্রেটরাই এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সেনাবিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করে।

কিন্তু রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ ক্যাথলিকদের সাথে মিটমাটের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের নিকট থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়, তখন ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চ সমস্যায় পড়ে যায় রাশিয়ান চার্চের অধীন হওয়ার কারণে। তখন এই বার্থোলোমিউ পশ্চিমা ইন্ধনে ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চকে ‘অটোসেফালাস’ বা স্বাধীন চার্চের স্বীকৃতি দেয়। তখন পুতিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিল যে, Moscow blames Trump administration for schism in the Orthodox world (মস্কো ট্রাম্প প্রশাসনকে অর্থোডক্স জগতে বিভেদ ঘটানোর দায়ে অভিযুক্ত করছে)

ইউক্রেনের চার্চকে রাশিয়ার অধীনতা থেকে সরিয়ে দেয়ার এই ঘটনার পর ২০১৮ সালে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কিরিল, বার্থেলোমিউর সাথে সম্পর্ক ছেদ করে, যা 2018 Moscow–Constantinople schism নামে পরিচিত। পশ্চিমা ইন্ধনে ইস্তাম্বুলের বার্থেলোমিউর এই ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমকে প্রতিহত করতেই এরদোয়ান আয়া সুফিয়াকে ফের মসজিদে পরিণত করেন।

উল্লেখ্য, আয়া সুফিয়া যে এতোদিন মিউজিয়াম ছিল, তা ছিল একটি মধ্যবর্তী অবস্থা মাত্র। তাকে ফের চার্চ বানিয়ে সেটাকে কেন্দ্র করে অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের দিয়ে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রকে রূপ দেয়ার একটি চিন্তা বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। ২০০৮ সালেই গ্রিসে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আয়া সুফিয়াকে ফের চার্চে পরিণত করতে হবে। ২০২০ সালে এসে এরদোয়ান আয়া সুফিয়াকে মসজিদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে তাদের এই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেন।

যে কারণে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ মুখ রক্ষার্থে বিপক্ষে বিবৃতি দিলেও সেদেশের সরকারের তরফ থেকে কিন্তু বলা হয়েছে, এটি তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মূলত আয়া সুফিয়াকে মসজিদে পরিণত করায় রাশিয়ার পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে, কারণ সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল দখলের পর মস্কোকে অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা তাদের নতুন কেন্দ্র বলে ধরে নিয়েছিল, যে কারণে মস্কোকে বলা হয় ‘থার্ড রোম’ বা তৃতীয় রোম। একটি রোম হচ্ছে ভ্যাটিকান, আরেকটি রোম ছিল কনস্টান্টিনোপল। দুটি ছিল খ্রিস্টানদের দুটি শাখার প্রধান কেন্দ্র। কনস্টান্টিনোপল মুসলমানদের দখলে যাওয়ার পর অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা মস্কোকে নতুন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়, সে কারণে তাকে বলা হয় ‘থার্ড রোম’।

এমতাবস্থায় আয়া সুফিয়াকে কেন্দ্র করে ফের নতুন কেন্দ্র তৈরী হলে তা রাশিয়ার নেতৃত্বকে মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এরদোয়ান রাশিয়ার সেই আশঙ্কাকে দূরীভূত করেছেন, সাথে মুসলমানদেরও করেছেন নিরাপদ।

অনেকে রামমন্দিরের সাথে তুলনা দিতে চায়, তারা আসলে ইতিহাসই জানে না। মূলত গু খাওয়া একটি জাতির বাবরি মসজিদ ভাঙার উন্মাদ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে আয়া সুফিয়াকে মসজিদ করার যে হিকমত, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের যে সূক্ষ্মতা ও ঐতিহাসিক গভীরতা, তা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। সম্প্রতি খবরে এসেছে যে, বিগত অর্থবছরে ভারতের জিডিপি গ্রোথ হচ্ছে নেগেটিভ।

অনেকে আশঙ্কা করেছিল যে, ভারতের জিডিপি গ্রোথ ১ বা ২ শতাংশে নেমে আসবে, কিন্তু সেদেশের স্টেট ব্যাংকের প্রধান খবরে বলেছে যে, ১ বা ২ শতাংশ তো দূরে, ভারতের জিডিপি গ্রোথ এখন নেগেটিভ! কিন্তু তারপরও ভারতীয় দের কোনো বিকার নেই, কারণ তাদেরকে গোমূত্র আর মুসলমানের রক্তের নেশায় ভুলিয়ে রাখা রয়েছে, যেই নেশায় তারা ভাতকাপড়ের অভাবও রীতিমতো ভুলে যায়। 

Post a Comment

 
Top