ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৪টি ভাষা জানতেন, এই তথ্যটি তার জ্ঞানের উৎকর্ষতা প্রমাণে প্রায়শ তুলে ধরা হয়। কিন্তু তার চেয়েও অধিক ভাষা জানা জ্ঞানী ব্যক্তি সাতচল্লিশে দেশবিভাগের পর এদেশকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তিনি হলেন আহমদ হাসান দানী। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত আহমদ হাসান দানী ৩৫টি ভাষা জানতেন, তার সাবজেক্ট ছিল প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসবিদ্যা। পাকিস্তান আমলে তিনি বাংলাদেশে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এতদাঞ্চলে মুসলিম শাসনামলের মুদ্রা, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা তার দ্বারা শুরু হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের রেহমান দেহরিতে সিন্ধু সভ্যতা পূর্ববর্তী প্রত্নস্থল, দীর অঞ্চলে ইন্দো-গ্রিক প্রত্নস্থল, পেশোয়ারে ও সোয়াত উপত্যকার নিকটবর্তী গান্ধার সংস্কৃতির প্রত্নস্থল আবিষ্কার করেন।

৩৫টি ভাষা জানা আহমদ হাসান দানী ছিলেন বেনারসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড মার্কস ও স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। নিয়ম অনুযায়ী তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ পেলেও তাকে শিক্ষকতা করতে দেয়া হয়নি, কারণ তিনি মুসলমান। মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, তাদের প্রতিভা সংরক্ষণের জন্য। দেশবিভাগ না হলে আহমদ হাসান দানী যে এতোবড় প্রতিভা, তার ছিটেফোটাও প্রকাশিত হতো না। কারণ প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশই তিনি পেতেন না।

এই কথাগুলো এই তুলনা টানার জন্য বলছি না যে, দেখো ভারতে স্বর্ণপদক পাওয়া আহমদ হাসান দানীকেও সামান্য লেকচারার হিসেবে কাজ করতে দেয়নি মুসলমান বলে, ওদিকে ১৭ জন সিনিয়র অধ্যাপককে টপকে সত্য পসাদকে বুয়েটের ভিসি পর্যন্ত বানিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু বলে! বরং আমি বলতে চাচ্ছি, হিন্দুদের অবস্থানটাই বরং স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সরকার পরিবর্তন হলে সেদেশের প্রশাসনের টপ টু বটম পরিবর্তন হয়। আওয়ামী আমলে আওয়ামীপন্থী সচিব, বিএনপি আমলে বিএনপিপন্থী সচিবদের পদায়ন করে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়। ওবামার পর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিবর্তন হয়। কারণ খুবই স্বাভাবিক, বিএনপির সচিব তো আওয়ামী প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। ডেমোক্রেট ওবামার রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে তো রিপাবলিকান ট্রাম্প সরকারের এদেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়িত হবে না।

ঠিক সেভাবেই আহমদ হাসান দানী যতোই যোগ্যতাসম্পন্ন হোন না কেন, তিনি তো বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হতে পারেন না। পৃথিবীর প্রতিটি আত্মসচেতন জাতিই প্রথমে দেখে, যাকে সে নিয়োগ দিচ্ছে সে তার অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কিনা, কেবলমাত্র অছাম্প্রদায়িক জাতি বাদে।

বুয়েটে হিন্দু ভিসি নিয়োগ দেয়া নিয়ে একটা পোস্ট পড়লাম সম্প্রতি। পোস্টদাতা লিখেছে যদি ‘যোগ্যতার খাতিরে’ নিয়োগ দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে সত্য পসাদকে স্বাগত! আসলে ‘যোগ্যতা’র সংজ্ঞা কি, এটা অছাম্প্রদায়িক জাতির অনুধাবনের বাইরে। একজন সচিব কিংবা আমলা যতো দক্ষই হোক না কেন, বিএনপিপন্থী হলে তাকে আওয়ামী লীগ কখনোই জায়গা দিবে না। কারণ অস্তিত্বের খাতিরে আওয়ামী লীগের নিকট ‘যোগ্যতা’ বলে পরিগণিত হবে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করাকে, যার দ্বারা আওয়ামী লীগের স্বার্থোদ্ধার হয়।

বিপরীতে অছাম্প্রদায়িক জাতির নিজস্ব অস্তিত্ব, আদর্শ কিংবা অবস্থানের বালাই নেই! আদর্শহীন অছাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী হয় সুবিধাবাদী, সে চিন্তা করে যদি ‘যোগ্যতা’র দোহাই দিয়ে হিন্দুমিন্দু দ্বারা পুলিশ-প্রশাসন-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভরে ফেলা যায়, তবেই মিডিয়া-ভারতীয় দাদারা তাকে উঠতে-বসতে বাহবা দিবে। যোগ্যতার দোহাই দিয়ে হিন্দু নিয়োগ দেয়ার ঝোঁক থেকেই অবচেতন মনেই অছাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হয়ে উঠে নিজ সম্প্রদায় বিদ্বেষী, তখন তার নিকট ভিন সম্প্রদায়ের পরিচয় বহন করাটাই প্রধান যোগ্যতা হিসেবে পরিগণিত হয়। মৌলভীবাজারের বটতলার উকিল তখন হিন্দু-উপজাতি পরিচয় বহন করার কারণে বসতে পারে প্রধান বিচারকের পদে।

বাংলাদেশে সত্য পসাদকে বসানো হয়েছে তার হিন্দু পরিচয়ের কারণে, যোগ্যতার দোহাই দেয়াটা এখানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই নিস্ফল। সুতরাং তার বিরোধিতাও করতে হবে এই গ্রাউন্ড থেকে যে, সে হিন্দু সুতরাং সে বুয়েটের ভিসি হতে পারে না। এটা রেসিজম নয়, বরং বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

কিন্তু আফসোস, অছাম্প্রদায়িক জাতি অস্তিত্ব কি, সেটাও যে বোঝে না! তার পরিচয়টাই হলো সে অ-সাম্প্রদায়িক। নিজের সম্প্রদায়গত পরিচয় অস্বীকার করে অপর সম্প্রদায়ের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াটাই তার নিকট চরম সার্থকতা বলে পরিগণিত হয়।

Post a Comment

 
Top