কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য যারা বুঝতে পেরেছেন, তারা একটি বিষয় সকলেই খেয়াল করবেন যে, কাজী নজরুলের প্রত্যেকটি কবিতায় রয়েছে অব্যক্ত বেদনা ও কান্নার ছাপ। এই বেদনা ও কান্না উৎসরিত হয়েছে কাজী নজরুলের সংসারজীবনের অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে, যে প্রসঙ্গে সূফী জুলফিকার হায়দার তার ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়’ (১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
//আমার মনে হয়, নজরুলের বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারটি তাঁর জীবনের একটি বড় অভিশাপ। বাড়িতে তিনি ‘ভগবান’ এবং ‘জল’ বলতেন, আবার মুসলমানদের সামনে ‘আল্লাহ’ এবং ‘পানি’ বলতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি একেবারে নির্ভেজাল হিন্দু আগেও ছিল এবং বরাবর আমি তাই দেখেছি। এই পরিবেশেই তিনি একদিকে যেমন লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত, অপরদিকে তেমনি হৃদয় উজাড় করে রচনা করেছেন ইসলামী হামদ্, না’ত, গজল আর কবিতা। এ ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি, ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ লেখার জন্য তাঁকে প্রতিকুলতা সহ্য করতে হয়েছে যথেষ্ট। এমনকি তার শ্বশুরকুলের অনেকের কাছ থেকে-বিশেষ করে শাশুড়ীর কাছ থেকে নির্মম বাক্যবাণ ও উপহাস সহ্য করতে হয়েছে। ...
নজরুলের দুটি ছেলে-সানি আর নিনী (কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ) মুসলমানী বিধান অনুযায়ী আমি ওদের খতনা করাবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কবিকে রাজী করাতে পারিনি। তার কারণ অবশ্য সুস্পষ্ট। তাঁর শ্বাশুড়ী ও স্ত্রীর কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করার শক্তিও নজরুলের ছিল না।//
নজরুল ও তার পরিবারের শেষ সময়ের সঙ্গী সূফী জুলফিকার হায়দার যেভাবে কষ্ট পেয়েছিলেন, সেরকম কষ্ট নজরুলও কম পাননি। মুসলমান হয়েও বাসার হিন্দুদের চাপে পানির বদলে জল বলেছেন, এমনকি নিজের সন্তানদের মুসলমানিও করাতে পারেননি তিনি। নজরুল ছিলেন হিন্দুদের খাঁচায় আবদ্ধ বুলবুল, যে বুলবুলের করুণ সুর বারংবার প্রতিধ্বনিত হতো তার কাব্যসাহিত্যে। কিন্তু তারপরও মুসলমানদের পয়সা থেকে সুবিধা নেয়ার প্রবণতা হিন্দুদের সবসময়ই ছিলো। নজরুলের প্রতিভা যখন মধ্যগগণে, যখন নজরুলের হাতে অঢেল পয়সা, তখন নজরুলের আশেপাশে পঙ্গপালের মতো ভীড় করে থাকতো তার হিন্দু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। সূফী জুলফিকার হায়দারের ভাষায়-
“কবির আর্থিক স্বচ্ছলতার দিনে কবি তার স্ত্রী, শ্বাশুড়ী ও শ্বশুরকুলের অনেকে দল বেঁধে হাওয়া বদলাবার জন্য পশ্চিমে যেতনে। এক এক যাত্রায় কবিকে বেশ মোটা রকমের অর্থ খরচ করতে হতো ও ধারকর্জের কবলে পড়তে হতো। তাছাড়া, সবসময় তার বাড়ীতে অতিরিক্ত লোকজনের ভীড় লেগেই থাকতো। এতে করে এক বিরাট পরিবারের খরচ তাকে বহন করতে হতো। অথচ নিজের পরিবার বলতে তার ছিলো কেবল দুটি ছেলে, স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি। একদিন কবি অত্যন্ত বেদনার সাথেই বলেছিলেন- হায়দার. আমার শ্বাশুড়ীকে তুমি তো জানো না। ওরা হচ্ছেন যেন রাঘব বোয়াল, কিছুতেই আমি ওদের পেট ভরাতে পারলাম না।’’
কিন্তু নজরুলের অতিথিরা ততোদিনই তার পাশে ছিলো, যতোদিন তার হাতে টাকা ছিলো। তার আর্থিক টান যখন দেখা দেয়, তখনই নজরুলের শ্বশুরকুলের ঐসব দুধের মাছিরা তার সঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। একপর্যায়ে নজরুলের যখন মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দেয়, তখন নজরুলের শ্বাশুড়িও বাড়ি ত্যাগ করে। নজরুলের অসুস্থতা দেখা দেয়ার পর থেকে ৪৭-এ দেশবিভাগের আগপর্যন্ত নজরুল ও তার পরিবারের একনিষ্ঠ সেবা করেছিলেন সূফী জুলফিকার হায়দার। এ সময়ে কলকাতায় হিন্দুরা ছড়িয়ে দেয় যে, নজরুলের নাকি সিফিলিস হয়েছে। যদিও নির্বাক নজরুল এই বিশ্রী অপবাদের অনেক উর্ধে তখন। একপর্যায়ে পাকিস্তান হলো, সূফী জুলফিকার হায়দার বাধ্য হলেন কলকাতা ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসতে।
এর পর বাংলাদেশে আনার আগপর্যন্ত কাজী নজরুল ও তার পরিবারকে কলকাতায়ই থাকতে হয়েছে। সেখানে নজরুলের পরিবারের অবস্থা কী ছিলো? কবির নাতনী খিলখিল কাজীর ভাষায়- //তার বাবা কাজী সব্যসাচীর লেখা চিঠি থেকে দেখা যায় কবিকে বার বার বাড়ি পালাটতে হয়েছে, চিকিৎসা এবং অর্থের অভাবে কষ্ট পেতে হয়েছে । তিনি বলেন , সেসময় কাজী সব্যসাচী পাকিস্তানে পালিয়ে এসে বার বার পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে চিঠি লিখে জানান তার বাবাকে পশ্চিমবঙ্গে শুধুমাত্র মুসলমান হিসাবে দেখা হচ্ছে , তারা পাকিস্তানে আসতে চান। কিন্তু এর কোন সাড়া সেসময় কবি পাননি// (http://goo.gl/gtgv38)
আসলে হিন্দুদের সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। নজরুলের হাতে যখন টাকা ছিলো, তার কলমের ডগায় যখন কবিতা ছিলো, তখন নজরুল হিন্দুদের নিকট ছিলেন জামাইঠাকুর। আর যখনই নজরুল নির্বাক হয়ে গেলেন, তখনই হিন্দুদের চোখে তিনি হয়ে গেলেন ‘মুসলমান’! শুনলে খারাপ শোনালেও নজরুলের উদাহরণ দেয়া যায় সেসব সন্তানদের সাথে, যারা স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির কথায় নেচে মাকে ত্যাগ করে। মা এজন্য মনে কষ্ট পান, সন্তানকে নিয়ে হয়তো আক্ষেপ করে দু-একটি অভিসম্পাতও করেন। কিন্তু তারপরও মা তো মা-ই, সন্তান যদি শ্বশুরকুল থেকে বিতাড়িত হয়, তাবে মা তার সন্তানকে ফের বুকে টেনে আনতে দ্বিধা করেন না। নজরুলও ঠিক তেমনি হিন্দু শ্বশুরবাড়ির কথায় ভুলে মুসলমান সমাজকে ত্যাগ করে, প্রতারিত হয়ে ফের ফিরে এসেছিল তার মায়ের কোলে, তার নিজের বাঙালি মুসলিম সমাজে।
আমরা মুসলমানরা কেন নজরুলের যৌবনের সোনালি দিনগুলো পেলাম না? এর উত্তর সুফী জুলফিকার হায়দার এভাবে দিয়েছেন যে-“নজরুলের বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারটি তাঁর জীবনের একটি বড় অভিশাপ”। (এ নিয়ে আমার পূর্বের পোস্ট: https://goo.gl/8ucnq6) নজরুল মুসলমান স্ত্রীকে বাসররাতে ত্যাগ করে হিন্দু সেনগুপ্ত পরিবারের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি হিন্দুদের প্ররোচনায় হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে হিন্দুদের খাঁচায় বন্দী হন। সেই হিন্দুরাই নজরুলের সোনালি সময়গুলো কেড়ে নিয়ে, তাকে চুষে খেয়ে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। সুবিধাবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা নজরুলকে দেখেছিল দুধ দেয়া গাভী হিসেবে, যার দুধ বন্ধ হওয়ার পর তাকে দানাপানি না দিলেও চলে।
পক্ষান্তরে আমরা অশ্রুসজল নয়নে গ্রহণ করেছি নির্বাক অসুস্থ নজরুলকে। যে নজরুল লিখতে জানে না, যে বুলবুল গান গাইতে জানে না। নজরুলের জীবনী থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছুই রয়েছে। আমাদের কারো সন্তানের পরিণতি যেন নজরুলের মতো না হয়, সেজন্য আমাদের সন্তানদেরকে হিন্দুদের হাক্বীক্বত সম্পর্কে অবগত করা উচিত। বিশেষ করে এই আয়াত শরীফ আমাদের প্রত্যেকের সন্তানদেরকে বারবার শিক্ষা দেয়া উচিত যে- “নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে পাবে প্রথমত ইহুদীদের, অতঃপর মুশরিকদের” (সূরা মায়িদা, আয়াত শরীফ ৮২)

Post a Comment

 
Top