কাজী নজরুল ইসলাম যখন প্রমীলা ওরফে আশালতা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করবেন তখনকার ঘটনা। বর মুসলমান ও কনে হিন্দু, এ কারণে প্রশ্ন উঠলো যে, বিয়ে কোন মতে হবে? হিন্দু মতে তো হতে পারে না। হতে পারে সিভিল অ্যাক্টে, যেখানে বলা হয়েছে যে বর ও কনে উভয়কে স্বীকার করতে হবে যে, “আমি কোন ধর্ম মানি না।” শুনে কাজী নজরুল ইসলাম প্রবল আপত্তি জানালেন। বললেন-“আমি মুসলমান-মুসলমানী রক্ত আমার শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারবো না।”
এখন বিয়ে করার উপায় কী? কাজী নজরুল ইসলাম মত দিলো, হিন্দুদেরকে ‘আহলে কিতাব’ হিসেবে ধরা হউক। কাজী নজরুল এবং তার উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদের যুক্তি ছিলো, যেহেতু একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল পৃথিবীতে এসেছেন, সেহেতু হিন্দুদের কোন নবীর উম্মত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং তাদেরকে আহলে কিতাব হিসেবে ধরে মুসলমানী মতে বিয়ে পড়ানো হউক।
এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে নজরুলের বন্ধু কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের রচিত ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ বইতে। আমরা জানি যে, পবিত্র কুরআন শরীফ অনুযায়ী মুশরিক মেয়েদেরকে বিয়ে করাটা সরাসরি নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম পাগলাটে হওয়ার কারণে নিজের খেয়ালখুশিমতো একটি ব্যাখা দাঁড় করালেন, মুশরিক হিন্দুদের আহলে কিতাব ফতোয়া দিয়ে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেন। এতে শুধু তারই দোষ রয়েছে তা নয়, কারণ তার সাঙ্গপাঙ্গরাও তাকে উৎসাহ দিয়েছিল। ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ বইয়ের লেখক খান মঈনুদ্দীনও তাদের মধ্যে একজন।
এরকম আরো অনেকগুলো কারণেই কাজী নজরুল ইসলামকে কাফের ফতওয়া দেয়া হয়েছিল, আর দেয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের খাতিরে যদি আমরা বিচার করি, তাহলে দেখবো যে উক্ত হিসাব অনুযায়ী আমরা সকলেই আসলে কাফের হয়ে গেছি। কারণ বর্তমান সরকার মুসলিম পারিবারিক আইনে বহু মনগড়া কাটছাঁট করে, যেগুলোর সবগুলোই কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী। কিন্তু মুসলমানরা তার প্রতিবাদ না করে হাসিমুখে মেনে নেয়। বিপরীতে হিন্দুদের আইনে পান থেকে চুন খসানো যায় না, এমনকি তাদের ম্যারিজ রেজিস্ট্রির আইনও সরকার করতে পারেনি। কাজী নজরুলের বিয়েটা হিন্দু মতে করা যায় কিনা তা প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু তা সম্ভব ছিলো না হিন্দু আইনের গোঁড়ামির কারণে।
কাফের ফতওয়া দেয়াটা ছিল কাজী নজরুলের পাগলামির জবাবে মুসলমান সমাজের প্রতিবাদস্বরূপ। নাস্তিক ও হিন্দুরা সেটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিরাট করে প্রচার করে। অথচ এই হিন্দুরা যে কতোটা নীচে নেমেছিলো কাজী নজরুলের বিরোধিতার জন্য, তা কেউই জানে না। হিন্দুরা কাজী নজরুলের কবিতার প্যারোডি বের করতো, আর তা ভয়াবহ অশ্লীল প্যারোডি। মুসলমান কবি ভালো কবিতা লিখছে, এটাই ছিলো হিন্দুদের ঈর্ষার কারণ।
সাংবাদিক শেখ দরবার আলম রচিত ‘অজানা নজরুল’ বইয়ের ‘সজনীকান্ত দাস: যে দৃষ্টিভঙ্গি অশ্লীল ও সাম্প্রদায়িক’ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নব পর্যায় ‘শনিবারের চিঠি’ ভাদ্র ১৩৩৪-এ শ্রী সনাতন দেব শর্মা ছদ্মনামে ‘নব যুগান্তর (বন্দনা)’ শিরোনামে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘সিন্ধু’ নিয়ে ব্যঙ্গ করে প্যারোডি প্রকাশিত হলো-
“কাম-ব্যথা- যৌনভাব আর
সুলভ স্ত্রীজনসঙ্গ লয়ে
মিশায়ে তাহাতে যথা-তথা উত্থলিত অশ্রুরাশি
‘সিন্ধু’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের ভাষা ছিল নিন্মরূপ-
“হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি,
সুন্দর সুন্দর!”
“সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর!
সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা,
সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা,”
আর এই অনবদ্য সৃষ্টিকে ব্যঙ্গ করে ‘শনিবারের চিঠি’র অবৈধ হিন্দুসন্তানরা ছাপলো এই অশ্লীল প্যারোডি-
“হে অপূর্ব
নাহি জানি জন্ম লভ কোথা
সদাই খুঁজিয়া ফিরি মাতার অন্তরে
যৌন প্রবণতা”
‘শনিবারের চিঠি’র উক্ত সংখ্যায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘অ-নামিকা’ কবিতাটি ব্যঙ্গ করেও অশ্লীল প্যারোডি ছাপা হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের মূল ‘অ-নামিকা’ কবিতাটি ছিল নিম্নরূপ-
“তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন-সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করিৃ.
হে আমার মানস-রঙ্গিণী,
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
‘শনিবারের চিঠি’তে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামটি ব্যঙ্গ করে ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ ছদ্মনাম দেয়া হলো। ‘অ-নামিকা’ কবিতাটি ব্যঙ্গ করে নাম দেয়া হলো ‘অঙ্গুষ্ঠ’। তারপর উপরের কালজয়ী কবিতাটি ব্যঙ্গ করে, প্যারোডির নামে উগ্র হিন্দুরা রীতিমতো পর্নোগ্রাফি ছাপলো ‘শনিবারের চিঠি’তে-
“তোমারে পেয়ার করি
কপনি-লুঙ্গি পরি
লো আমার কিশোরী নাতনী
সুদূর ভবিষ্য-লোকে নিশীথ নির্জন কুঞ্জে সে টোকা-ঘাতিনী
তোমারে পেয়ার করি
শৈশবের ওগো উলঙ্গিনী
অ-পাতা শয্যায় অ-শোয়া সঙ্গিনী
তোমারে পেয়ার করি।”
‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার সজনীকান্ত দাস ছিলো চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু, যার নেতৃত্বে এসব অশ্লীল প্যারোডি ছাপা হতো নজরুলের কবিতাকে ব্যঙ্গ করে। খেয়াল করলে দেখবেন, প্যারোডিতে ‘লুঙ্গি’র প্রসঙ্গ এনে সাম্প্রদায়িক খোঁচা দেয়া হয়েছে। মূলত হিন্দুদের কবিতার মূলধারাই হলো আদিরসাত্মক অশ্লীল কবিতা। যেমন হিন্দুদের অন্যতম প্রধান কবি ভারতচন্দ্র, যার ‘আমার সন্তান’ কবিতাটি বর্তমান এসএসসি লেভেলে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। তার একটি কবিতার ভাষা হলো-
“মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া
অদ্যপি কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া
কুঁচ হইতে কত উচ্চে মেরু চুড়া ধরে
শিহরে কদম্ব ফুল দাড়িম্ব বিদরে”
চরম অশ্লীল কবিতা এটি, যার বক্তব্য ব্যাখা করে বোঝানো সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ বইটি হিন্দুদের মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভূক্ত, যাকে কিনা ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেয় হিন্দুরা। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের রচয়িতাই যদি এরূপ অশ্লীল কবিতা লিখে, সেক্ষেত্রে বাকিটা না বললেও চলে।
এখন মুসলমানরা আর যা-ই হোক, কাজী নজরুলকে নিয়ে এসব নোংরামি তারা কখনোই করেনি। মুসলমানদের কাফের ফতওয়া ছিলো অবাধ্য সন্তানের প্রতি অভিভাবকের ভর্ৎসনা স্বরূপ, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ নয়। কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলমানরা ভালোবাসতো বলেই তাকে কাফের ফতওয়া দিয়েছিল, আর হিন্দুরা তাকে ঘৃণা করতো বলেই তার কবিতা নিয়ে অশ্লীল প্যারোডি ছেপেছিল।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামের শেষ জীবনে। নজরুল যখন নির্বাক হয়ে যান, তখন হিন্দুরা তাকে আলাদা করে দেয়। বিবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে নজরুলের নাতনী কাজী খিলখিলের ভাষায়, কাজী সব্যসাচী (খিলখিলের বাবা) পাকিস্তানে পালিয়ে এসে বার বার পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে চিঠি লিখে জানান তার বাবাকে পশ্চিমবঙ্গে শুধুমাত্র মুসলমান হিসাবে দেখা হচ্ছে , তারা পাকিস্তানে আসতে চান। (http://goo.gl/gtgv38)
পাকিস্তান সরকার তাদেরকে গ্রহণ না করলেও দেশ স্বাধীনের পর বাঙালি মুসলমানরা কবি পরিবারকে ঠিকই গ্রহণ করেছিল। কারণ সন্তান যখন অবাধ্য হয়, তখন পিতামাতা তাকে ভর্ৎসনা করে ঠিকই, কিন্তু সেই সন্তান পিতামাতার কোলে আশ্রয় খুঁজতে চাইলে পিতামাতা তাকে দূরে ঠেলে দেন না।

Post a Comment

 
Top