আসলে তালাক কী? তিন তালাক বললেই কেন তালাক হবে? আসলে শুধু তিন তালাক বললেই নয়, আরো অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে আপসেআপ তালাক পড়ে যায়। এর মধ্যে একটি অন্যতম হলো কুফরী কথা, কাজ বা আক্বীদা পোষণ করা। কারণ দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কের বৈধতার ভিত্তি হলো তাদের মুসলমানিত্ব। তাদের যে কেউ একজন ইসলাম থেকে চ্যুত হয়ে গেলে আপসেআপ তালাক পড়ে যায়।

পূর্বের যুগে মুসলমানরা এজন্য অত্যন্ত ধার্মিক ও বিনয়ী হতো। কারণ একজন মুসলমানকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হতো যে, তার কোন কথা কিংবা কাজের দ্বারা কুফরীর হুকুম বর্তায় কি না। কারণ কুফরীর হুকুম বর্তালেই তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ব্যভিচার বলে পরিগণিত হবে, সন্তান হলে তা অবৈধ হবে। আগে কেউ প্রকাশ্যে কুফরী করলে জনসমক্ষে ফতোয়া আকারে প্রচার করা হতো যে, উক্ত ব্যক্তি কুফরী করেছে এবং তার স্ত্রী তালাক হয়ে গিয়েছে।

বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’ গ্রন্থে রয়েছে, বিষাদসিন্ধু’র লেখক সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন তার ‘গোজীবন’ প্রবন্ধে গরুর গোশত আহার করা থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলো। টাঙ্গাইলের ‘আহমদী’ পত্রিকায় ‘গোজীবন’ প্রবন্ধের প্রথম প্রস্তাব ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ ছাপা হলে স্থানীয় অন্য একটি পত্রিকা ‘আখবারে এসলামিয়া’র সমালোচনায় বলা হয়- মীর সাহেব মুসলমান নয়। এ উক্তির সমর্থনে আরো রচনা পত্রস্থ হয় এবং টাঙ্গাইলের সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌলভী শফিউদ্দীনের বাসগৃহে মাহফিল করে লেখককে ‘কাফির’ স্থির করা হয়, সাথে সাথে তার স্ত্রী তালাক হবার ফতোয়াও জারি করা হয়। ক্ষুব্ধ মীর মশাররফ হোসেন এদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করে।

মীর মশাররফ শিয়া ছিল বিধায় ঔদ্ধত্যবশত মামলা করেছিল, কিন্তু সাধারণ সুন্নী মুসলমানরা এ কারণে সবসময় নিজের কথা এবং কাজের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকত। কারণ কুফরীর ফতোয়া জারি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হতো না নিজের স্ত্রীর সাথে একত্রে সংসার করা, করলে তাকে নির্ঘাত একঘরে হতে হত।  সুতরাং বুঝতেই পারছেন, তালাক তখন মুসলমানদেরকে তাদের মুসলমানিত্ব সম্পর্কে খুবই সতর্ক রাখত। তালাক ছিল ঈমান ও আক্বীদার রক্ষাকবচ।

সম্প্রতি ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি সেদেশে তিন তালাক দেয়াটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর বিপরীতে ভারতের মুসলমানদের মনোভাব দেখে একটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে, তাদের নমনীয়তা ও সমর্থনের কারণেই মোদি সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার ধৃষ্টতা দেখানো। ভারতের বিভিন্ন মুসলমান নামধারী ফেসবুকার প্রচার করছে যে, শরীয়তে তিন তালাক থাকলেও ‘ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক’ দেয়াটা নাকি শরীয়ত অনুসারে সঠিক নয়, অর্থাৎ মোদি সরকার ভুল কিছু করেনি।

আসলে ভারতের মুসলমানদের সমস্যা সহজে বোঝা যায়। যেখানে শরীয়ত অনুসারে সামান্য কুফরী বাক্য উচ্চারণ করলেই ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক পড়ে যায়, সেখানে ভারতীয় মুসলমানরা অহরহ এমন সব কথা লিখে থাকে ফেসবুকে, যেগুলো পড়ে বাংলাদেশের বে-নামাজী ফাসিক মুসলমানদেরও মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে।  “আমার চেনা হিন্দুত্ব ঠাকুর রামকৃষ্ণ দিয়ে গড়া, স্বামী বিবেকানন্দ দিয়ে গড়া। সেই হিন্দুত্বের উদারতার কাছে আমি রোজ মাথা নত করি। তাতে অন্ততপক্ষে আমার আল্লাহ রুষ্ট হন না।” (https://goo.gl/rFtDUX)

হিন্দুদের মন জোগাতে ভারতীয় মুসলমানদেরকে তো বটেই, তাদের ধর্মগুরুদেরও প্রায়ই এসব কুফরী কথা উচ্চারণ করতে হয়। বিগত কংগ্রেস শাসনামলে প্রত্যেক বছর কুরবানীর সময়ে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে ঘটা করে ফতোয়া জারি করা হতো। ভারতীয় মুসলিম জনগণের উদ্দেশ্যে দেওবন্দ থেকে বলা হতো, হিন্দুদের দেবতা বিধায় আপনারা গরু কুরবানী করবেন না। (https://goo.gl/TYxRGf)

যেখানে একটিমাত্র প্রবন্ধ লেখার দায়ে মীর মশাররফের স্ত্রী তালাক হওয়ার ফতোয়া জারি হয়েছিল, সেখানে ফি বছর গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে যাওয়া দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপর শরীয়তের হুকুম কী, তা বলাই বাহুল্য। এ কারণে ভারতীয় মুসলমানরা তালাকের সঠিক মাসয়ালা স্বীকার করতে চায় না, স্বীকার করতে চায় না ‘ইনস্ট্যান্ট তালাক’ এর অস্তিত্ব। কারণ তা স্বীকার করলে তাদের নিজেদের অবস্থাই লেজেগোবরে হয়ে যাবে।

Post a Comment

 
Top