১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে একটি ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিল বিবেকানন্দ ওরফে নরেন্দ্রনাথ দত্ত। হিন্দুরা তাদের ইতিহাসের বইগুলোতে ঘটনাটি খুবই গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, বিবেকানন্দের ষাট-সত্তর বছর আগেও তো অনেক হিন্দু পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দাদা গিয়েছে, রামমোহনও গিয়েছে। তারা কি কেউ হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করেনি?

করেনি, কারণ রামমোহন কিংবা রবীন্দ্রনাথের দাদারা যখন ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়েছিল, তখনও হিন্দুধর্মকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার মতো গাঠনিক রূপ দেয়া হয়নি। ব্রিটিশরা আসার আগে মুসলিম শাসনামলে সভ্যতার মাপকাঠি ছিল মুসলমানদের পোষাক, মুসলমানদের আদব-কায়দা এবং মুসলমানদের ভাষা ও শিক্ষা। আমরা জানি যে, মুসলিম শাসনামলে হিন্দুরা মুসলমানদের অধীনে বিভিন্ন রাজকার্যে নিযুক্ত ছিল। যেসব হিন্দুরা মুসলমানদের অধীনে চাকরি করত, তারা কিন্তু ধুতি-নেংটি পরা হিন্দু ছিল না। তারা ছিল মুসলমানদের পোষাক পরা, মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফারসি শেখা ‘ইসলামীকরণকৃত’ হিন্দু।

অর্থাৎ ঐসব হিন্দুরা মুসলমানদের অধীনে চাকরি করার সময় হিন্দুধর্মকে রিপ্রেজেন্ট করত না। যদি করত, সেক্ষেত্রে মুসলমানদের অধীনে চাকরি করার মতো সভ্যতাই তারা অর্জন করতে পারত না। ব্রিটিশ আমলে ঠিক একই অবস্থা ছিল রামমোহন কিংবা রবীন্দ্রনাথের দাদাদের। তারা হিন্দুধর্মকে রিপ্রেজেন্ট করা তো দূরের কথা, হিন্দুধর্মের প্রতি রীতিমতো ঘৃণাই পোষণ করতো। কারণ ব্রিটিশদের শর্তই ছিল এই যে, তাদের অধীনে থাকতে হলে নিজধর্মকে অবজ্ঞা করে খ্রিস্টধর্মকে বড় বলে জানতে হবে এবং তারা তা-ই জানত। এমনকি নিজেদেরকে ব্রিটিশ অনুগত হিসেবে প্রমাণ করতে গরুর গোশতও খেত তারা। মাইকেল মধুসুদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নাটিকায় এর উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হলো ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশরা ভারত থেকে বিতাড়িত হতে হতে টিকে গেল হিন্দুদের সহায়তার কারণে। ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ থেকে এই শিক্ষা নিল যে, ভারতে টিকে থাকতে হলে একদিকে ভারতবর্ষের মূল শাসকজাতি মুসলমানদের ধর্মকে আঘাত করতে হবে, অন্যদিকে এতোদিনের অখ্যাত হিন্দুধর্মকে আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানাতে হবে।

কাপালিকদের ছাইভস্মমাখা যেই হিন্দুধর্ম শশ্মান কিংবা জঙ্গলের বাইরে সভ্য সমাজে আসার উপযুক্ত ছিল না, সেই হিন্দুধর্মকে ঝাড়পোছ করে একটা চেহারা দেয়ার প্রজেক্ট শুরু করল ব্রিটিশরা। আস্তে আস্তে বেদ, উপনিষদ এগুলোকে হিন্দুধর্মের কথিত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দাঁড় করানো হল। মজার বিষয় হলো, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের আগে যেসব হিন্দুরা ব্রিটিশদের নৈকট্য লাভ করতে নিজধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করতো এবং গরুর গোশত খেত, তারাই ব্রিটিশদের এই হিন্দুধর্ম পুনর্জাগরণের নতুন প্রজেক্টে যুক্ত হয়।

বিবেকানন্দও ছিল সেরকমই এক ব্রিটিশপন্থী যুবক, যে প্রথম জীবনে ছিল ব্রাহ্ম। গতানুগতিকভাবে লেখা হয়, যে সে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মূল ইতিহাস হলো, বিবেকানন্দ ছিল ইহুদীদের গুপ্ত সংগঠন ফ্রিম্যাসনের সদস্য। ইহুদীদের ইশারাতেই সে ব্রাহ্মধর্ম ছেড়ে হিন্দুধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত হয়েছিল।

১৮৯৩ সালে, অর্থাৎ এখন থেকে ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় আগে শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে সে বক্তৃতা দিতে যায় এবং এটিই ছিল কোন হিন্দুর দ্বারা ভারতের বাইরে কোথাও হিন্দুধর্মকে তুলে ধরার সর্বপ্রথম ঘটনা। তার আগে রামমোহন গিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের দাদা গিয়েছে, কিন্তু তারা হিন্দুধর্মকে তুলে ধরেনি। চিন্তা করুন পাঠকেরা, ইউরোপীয়রা আজ থেকে ১২০০-১৩০০ বছর আগে মুসলিম দেশগুলোতে যেত শিক্ষা অর্জনের জন্য, সভ্যতা অর্জনের খাতিরে। বিপরীতে ১৮৯৩ সালে, অর্থাৎ সেদিন মাত্র এক হিন্দু গিয়ে সাদা চামড়াদের সম্মেলনে নিজের ধর্মটার স্বীকৃতি আদায় করে নিয়ে আসল, আর সেটা নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে ধন্য ধন্য পড়ে গেল!

অর্থাৎ যেই ব্যক্তিটি হাজার বছর ধরে সভ্য ছিল এবং অন্যকে সভ্যতা ও শিক্ষা দান করে এসেছিল, তারই ধর্ম ও জাতি তুলে আজ কটাক্ষ করছে সেই বনমানুষটি, যে কিনা কয়েকদিন আগে জঙ্গল থেকে বের হয়ে, গোসল করে আতর মেখে নিজেকে সভ্য সমাজে তুলে ধরার উপযুক্ত করল মাত্র। এজন্য যখনই কোন হিন্দু বাড়াবাড়ি করবে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করবে; তখনই মুসলমানদের কর্তব্য হবে জঙ্গল ভুলে লোকালয়ে ঢুকে পড়া হিংস্র পশুটির মতো তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা। মুসলমানরা আসলে হিন্দুদের ইতিহাস জানে না বিধায় তাদেরকে মানুষ বলে মনে করে, আর এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। “নিশ্চয়ই প্রাণীকুলের মধ্য নিকৃষ্ট তারাই, যার কাফির, যারা ঈমান আনেনি।” (সূরা আনফাল, আয়াত শরীফ ২২)

Post a Comment

 
Top