প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক ও বিভিন্ন বইতে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যতোগুলো জীবনী পাওয়া যায়, সবগুলোতে উনাকে রীতিমতো ‘সাধারণ মানুষ’ হিসেবে প্রমাণ করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। অধিকাংশ ওয়াজ মাহফিলে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিষয়ে আলোচনা আসলেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলার চেষ্টা করা হয়, ‘তিনি তো আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ’। কেউ কেউ উনাকে ‘বড় ভাই’ বলেও প্রচার চালায়, অথচ কুরআন শরীফে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিতা স্ত্রীগণকে উম্মুল মু’মিনীন বা মু’মিনগণের মাতা বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মাতার স্বামী কি কখনো ‘ভাই’ হয়? হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্ষেত্রে যতোবার ‘সাধারণ মানুষ’ সম্বোধন ব্যবহার করা হয়, ততোবার তো রবীন্দ্র-নিউটনের ক্ষেত্রে হয় না।

এর ফলে যা হয়, সাধারণ মুসলমানদের মনমগজে ঐ রবীন্দ্রর প্রতি যতোটা উচ্চধারণা জন্মে, ততোটা নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি জন্মে না। এখান থেকেই কিন্তু সূত্রপাত হয় নাস্তিকতার। অথচ কুরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, “হে হযরত উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম, আপনারা তো অন্য কোন মহিলাদের মতো নন।” (সূরা আহযাব, আয়াত শরীফ ৩২)

হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিতা স্ত্রীগণ যদি অন্য কোন মহিলাদের মতো না হন, তাহলে তিনি স্বামী হয়ে কি করে আর দশটা ‘সাধারণ মানুষ’ এর মতো হতে পারেন? কিছু কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তি রয়েছে, তারা একটিমাত্র আয়াত শরীফের বিকৃত ব্যাখা করে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাধারণত্ব আরোপ করে থাকে, তা হলো “আমি তোমাদের মতোই মানুষ, কিন্তু আমার ওপর ওহী নাযিল হয়ে থাকে”। (সূরা হা-মীম সিজদা, আয়াত শরীফ ৬)

ঐসব কথিত আলেম ও তাদের অনুসারীরা চিন্তা করে থাকে, “আমি তোমাদের মতোই মানুষ” এটুকুই যথেষ্ট নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর সাধারণত্ব আরোপ করার জন্য। ওহী নাযিল হওয়ার বক্তব্যটি যেন কোন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মাটির তৈরী তূর পাহাড়ের উপর আরশের ৭০ হাজার ভাগের ১ ভাগ তাজাল্লী নিক্ষেপের কারণে গোটা তূর পাহাড় ছাইয়ে পরিণত হয়েছিল। সেখানে স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার কালাম, তার শক্তি কি কম? কোন রক্ত-গোশতের দেহের উপর বজ্রপাত হলেই সেটির কোন অস্তিত্ব থাকে না, ওহী নাযিল হলে কী হবে? ওহী নাযিল যার উপর হবে, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। তিনি নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উনার বিশেষ কোন সৃষ্টি।

এ সম্পর্কিত বহু হাদীস শরীফের বিবরণ রয়েছে। মুসলিম শরীফে একখানা হাদীস শরীফ রয়েছে, যেখানে স্বয়ং নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজেই ইরশাদ করেছেন,

لَسْتُ كَاَحَدِكُمْ

“তোমাদের মধ্যে কে আছ আমার মতো?”

আসলেই তো, তিনি তো আমাদের মতো নন। পাক-ভারত উপমহাদেশে হাদীস শরীফের শিক্ষার সূচনাকারী শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহির রচিত ‘মাদারিজুন নবুওয়্যাত’ বইটি পড়ে দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। একটা নয়, একাধিক হাদীস শরীফ থেকে তিনি উনার কিতাবে প্রমাণ করেছেন যে, নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শরীর মুবারকের কোন ছায়া ছিল না। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই শান মুবারককে উল্লেখ করেছেন ‘কামালতে লাতাফাত’ নামে। আরবী ‘লতিফ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সূক্ষ্ম’, ‘লাতাফাত’ অর্থ সূক্ষ্মতা। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বিষয়টির উদাহরণ এভাবে দিয়েছেন যে, আলোর বিপরীতে ধরলে একটি সুঁইয়ের কোন ছায়া পড়ে না, কারণ সুঁই হচ্ছে সূক্ষ্ম জিনিস। ঠিক সেভাবেই আল্লাহ পাক উনার হাবীবকে ‘কামালতে লাতাফাত’ দান করেছেন অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করেই সৃষ্টি করেছেন, যে কারণে উনার ছায়া পড়ত না।

বর্তমানে নাস্তিক ও হিন্দুরা নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চরিত্রে ব্যভিচার, পরকীয়া ইত্যাদির অপবাদ আরোপের চেষ্টা করছে, কিন্তু কেন? উপরে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই যে কোন মুসলমান বুঝতে পারবে যে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিষয়গুলো এই পরকীয়া, ব্যভিচারের মতো ফালতু বিষয়ের বহু বহু উর্ধে। আবু জেহেল, আবু লাহাব কিংবা সমসাময়িক ইহুদীরা নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র নিয়ে কিছু বলারই অবকাশ পায়নি, কারণ তারা উনাকে নিজের চোখের সামনে দেখেছিল। তারা দেখত যে উনার মাথার উপর একখণ্ড মেঘ সর্বদা ছায়া দেয়, তারা দেখত যে মাটিতে উনার ছায়া পড়ে না, তারা দেখত যে উনার শরীর মুবারকে রয়েছে ‘মোহরে নবুওয়্যাত শরীফ’।

যেই সত্ত্বার ছায়াও মাটিতে পড়ত না, আর যা-ই হোক তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা মানুষ চিন্তাও করবে না। কিন্তু এই আলোচনাগুলোই কথিত মালানারা করে না। তারা ওয়াজে বসলেই ঘুরেফিরে একটা কথাই বারবার বলতে থাকে ‘তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষ’। এখন সাধারণ মানুষ তো প্রবৃত্তির তাড়নায় ভোগে, সুযোগ পেলে ব্যভিচার-পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। সুতরাং যদি নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ‘সাধারণ মানুষ’ বলে ব্যাপক প্রচার করা যায়, তাহলেই নাস্তিকদের ইসলাম অবমাননার পথ পরিষ্কার হয়। আর সেই কাজটিই করে যাচ্ছে কিছু নামধারী আলেম ও বিপথগামী মোল্লা-মৌলভীরা।

মওদুদীর বইতে সাহাবায়ে কিরামগণের সম্পর্কে যে স্বজনপ্রীতির মতো আপত্তিকর বিষয়ও টেনে আনা হয়েছে, এর উৎপত্তিও এই ‘সাধারণ মানুষ’ থিওরী থেকেই। সুতরাং নাস্তিক ও হিন্দুরা যে এখন ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে বক্তব্য দিচ্ছে, সে দায় মুসলমানদেরও। তারা যতোদিন এই ‘সাধারণ মানুষ’ নামক ভ্রান্ত থিওরী ত্যাগ না করতে পারবে, ততোদিন তাদেরকে নাস্তিকদের দৌরাত্ম্য সহ্য করতে হবে।

Post a Comment

 
Top