সাতচল্লিশে যখন ভারত ভাগ হয়েছিল, তখন অখণ্ড ভারতপন্থী  বুদ্ধিজীবী গোছের কিছু মুসলমান নামধারী নেতা ছিল। তাদেরকে প্রচলিত ভাষায় ‘কংগ্রেসী পোস্টারবয়’ বলা হত, কারণ কংগ্রেস তার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মুখোশ ধরে রেখেছিল ঐসব অতিপণ্ডিতমার্কা মুসলমানদেরকে পোস্টার বানিয়ে। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল কংগ্রেসী নেতা আবুল কালাম আজাদ, ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইয়ের লেখক।

ঐসব মুসলমান নামধারী অতিপণ্ডিতেরা ছিল মারাত্মক উদ্ধত প্রকৃতির। যেমন আবুল কালাম আজাদের মতো কংগ্রেসী নেতারা মুসলমানদের আলাদা ভূখণ্ডের দাবিকে ইহুদীদের ইসরায়েলের সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা করত না, এতো উদ্ধত ছিল তারা। এই আবুল কালাম আজাদ তার সাক্ষাৎকারে বলেছিল, “পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায় যেকোনো আন্দোলনে নেমে পড়তে পারে, যা মোটেই ধর্মভিত্তিক হবে না। আজকাল দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো প্রদেশে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানকার মুসলিম যুবসম্প্রদায় তুলনামুলকভাবে মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশের যুবসম্প্রদায় থেকে অধিকতর ধর্মভাবাপন্ন। আপনি দেখবেন, আলেমদের বর্ধিত প্রভাবেও পাকিস্তান ধর্মের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলবে।” (http://komashisha.com/?p=4048)

অর্থাৎ পাকিস্তানে ইসলামের ঔজ্জ্বল্য থাকবে না, যেটা নাকি হিন্দুস্তানে থাকবে, এই ভয় তখন দেখিয়েছিল আবুল কালাম আজাদের মতো অতি-পণ্ডিতেরা। বিবিসি বাংলায় “কলকাতার হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে কতটা চেনেন?” শিরোনামের একটি রিপোর্টে “নিলোফার নিশাদ” নামক এক ‘মুসলমান’ মহিলার মন্তব্য হলো-

"সকালের নামাজকে ফজরের নামাজ, সন্ধেরটাকে মগরিবের নামাজ বলে - বাকিগুলো জানি না। আসলে আমি সম্পূর্ণ নাস্তিক না হলেও কোনও ধর্মের মধ্যেই বেশী ঢুকতে চাই নি কখনও। একবার ওর মধ্যে ঢুকে গেলে বের হওয়া কঠিন।” (https://goo.gl/at7h5u)

আবুল কালাম আজাদ ভয় দেখিয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের যুবকেরা ধার্মিক হবে না, ধার্মিক হবে হিন্দুপ্রধান হিন্দুস্তানে থাকা ‘সংখ্যালঘু মুসলিম যুব সম্প্রদায়’! বিরাট পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী, ঠিক কিনা? তাই এখন ভারতে এমন শ্রেণীর মুসলমান যুবক-যুবতীর অস্তিত্ব রয়েছে, যারা জানেই না দিনে কয় ওয়াক্ত নামায পড়তে হয় কিংবা নামাযের নামগুলো কি কি!

বাংলাদেশের ফরিদপুরের একজন কংগ্রেসী নেতা ছিল ‘হুমায়ুন কবির’ নামে, যে দেশবিভাগের পর স্বদেশে ফেরত আসেনি অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার কারণে। সে-ও ছিল বিরাট অতিপণ্ডিত, ইসলামের আলোকে হিন্দুস্তানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করত। সাতচল্লিশে দেশবিভাগের পরই হিন্দুস্তানে শুরু হলো ভয়াবহ দাঙ্গা। ভারতে রয়ে যাওয়া হুমায়ুন কবিরের চোখের সামনে চৌষট্টির দাঙ্গায় কলকাতায় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হল। তার প্রতিবাদ যখন সে করল, তখন কলকাতার উগ্র হিন্দুত্ববাদী যুগান্তর পত্রিকায় তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দেয়া হল।

উল্লেখ্য, বর্তমান ভারতেও এসব অতিপণ্ডিতের অভাব নেই। সানাউল্লাহ খান, জিম নওয়াজ এরা অনলাইনে অতিরিক্ত পণ্ডিতি দেখিয়ে বেড়ায়। সানাউল্লাহ খান প্রচার করে যে, মুসলমানদেরকে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ ত্যাগ করতে হবে। জিম নওয়াজেরা বিভিন্নভাবে ব্যাখা করার চেষ্টা করে, কেন নবীজীকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রচারকারী নমশূদ্র তারক বিশ্বাসকে ক্ষমা করে দেয়াটা জরুরী!

এসব অতিপণ্ডিতের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা কুরআন শরীফ-হাদীস শরীফকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কুরআন শরীফে বারবার বলা হয়েছে কাফির-মুশরিকরা তোমাদের শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। এই সহজ সত্যটিই সাতচল্লিশে অতিপণ্ডিতেরা মানতে চায়নি, এখনকার গুলোও চায় না। সানাউল্লাহ খান গোষ্ঠীর লোকেরা বলে, বিজেপির হিন্দুত্ব খারাপ, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব ভাল। জিম নওয়াজ গোষ্ঠীর লোকেরা আবার অরুন্ধতী রায়-গৌরী লঙ্কেশদের ভক্ত। এরা নিজেদেরকে বিরাট পণ্ডিত মনে করে, তাই খোদার উপর খোদকারী করতেও এদের বাধে না।

সাতচল্লিশের অতিপণ্ডিতদের মতো বর্তমানের অতিপণ্ডিতেরাও বাংলাদেশী মুসলমানদের দেখতে পারে না, তাই বাংলাদেশী মুসলমানরা ভারতের বিরুদ্ধে অনলাইনে সোচ্চার হলেই এই অতিপণ্ডিতেরা তাদের দেশ-জাতি তুলে গালিগালাজ করে। কারণ এই অতিপণ্ডিতগুলো নিজেদেরকে মনে করে,মুই কি হনু রে! এরা বামপন্থীদের পাশে বসে, রামকৃষ্ণ মিশনের রাখীবন্ধনে গিয়ে হিন্দুত্ববাদকে ঠেকানোর দিবাস্বপ্নে মশগুল। কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই যে, বাংলাদেশী মুসলমানদের হিন্দুত্ববাদ বিরোধী কার্যক্রমের কারণেই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনো বিজেপি ক্ষমতা হাতে নিতে পারেনি।

বর্তমান যুগ অনলাইনের যুগ। বিজেপি যে ভারতের ক্ষমতায় বসেছে, তার পেছনে রয়েছে তাদের অনলাইন সেল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আমেরিকার ক্ষমতায় বসেছে, এর পেছনে তার ইহুদী জামাইয়ের বুদ্ধিতে অনলাইন প্রচারে বেশি টাকা ঢালাটাই ছিল মূল কারণ। ২০১৩-১৪ সাল থেকে বাংলা অনলাইন জগতে যে হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তার পুরোধা ছিল বাংলাদেশী মুসলমানরা। সেই কারণেই বাংলাভাষী বলয়ে বিজেপি প্রবেশ করতে পারেনি, যেটা হিন্দিভাষী বলয়ে তারা পেরেছে। সুতরাং এসব অতিপণ্ডিতেরা যদি হিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে নিজেদের জান আর মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের অতিপণ্ডিতি বাদ দিয়ে মুসলমান হতে হবে আর অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিনয়ী হতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে যে ভারতে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, ভামপন্থী-বিজেপি সকলেই তাদের শত্রু। বহির্বিশ্বের সাহায্য তাদেরকে নিতেই হবে। বাংলাদেশী মুসলমানদের সাহায্য এবং বুদ্ধি-পরামর্শ ব্যতীত তাদের বাঁচার আর কোন রাস্তাই কিন্তু খোলা নেই।

নতুবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্তঃসারশূন্য ঔদ্ধত্য দেখিয়ে হিন্দুদের ফুটবল হওয়াটাই হবে ভারতীয় মুসলমানদের নিয়তি।

Post a Comment

 
Top