হিন্দুদের ক্ষেত্রে জাতপাতের গুরুত্ব কতটুকু তা যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে বলা হবে যে নিচুশ্রেণীর হিন্দুর ছোঁয়া খাবার ব্রাহ্মণ খেতে পারেনা। শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পে বলা হয়েছে যে, কায়স্থ ছেলে সাপুড়ের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু তার হাতের রান্না করা ভাত খেতে পারেনা। অর্থাৎ তাদের জাত খাওয়ার পাতেই সীমাবদ্ধ, নিচুশ্রেণীর মেয়ের সাথে এক বিছানায় শুলে কিন্তু জাত যায় না :v বিপরীতে মুসলমানদের ক্ষেত্রে বংশপরিচয়ের বিষয়টি ভাতের হাঁড়িতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার গুরুত্ব ছিল প্রশাসন ও বিচারবিভাগে বিস্তৃত।

 ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল ওয়ারেন হেস্টিংস, বিচারবিভাগ ও প্রশাসনে কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য। ড. ওয়াকিল আহমদের ‘বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবী’ বইতে রয়েছে যে, আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য প্রার্থীদেরকে নিজের ‘শরাফতনামা’ দাখিল করতে হতো, অর্থাৎ তাকে প্রমাণ করতে হতো যে সে বহিরাগত আশরাফ মুসলমানদের বংশধর। লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদানের ক্ষেত্রেও বংশপরিচয় দেখা হতো। সৈয়দ, খন্দকার, শেখ এসব বংশের মুসলমানরা প্রশাসন থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি পেতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য। অর্থাৎ মুসলমানদের ক্ষেত্রে বংশপরিচয়ের গুরুত্ব হিন্দুদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ছিল।

একে ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে, কারণ শুরুতেই বলেছি ব্রাহ্মণ্যবাদ ছোঁয়াছুঁয়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে বংশপরিচয় ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য নয়, বরং জাতীয় উচ্চপদে বসানোর জন্য বিবেচনা করা হত। কারণ একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে কিছু কিছু পদে অবশ্যই ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু বর্তমান মুসলমানরা এই ইতিহাস জানে না বিধায় তারা ধারণা করে যে, মুসলমানদের মধ্যে বংশপরিচয়ের কোন গুরুত্ব ছিল না বিধায় নিচুশ্রেণীর হিন্দুরা দলে দলে মুসলমান হয়ে গেছে। আসলে বর্তমান মুসলমানরা তাদের পূর্বপুরুষদের ছিঁটেফোটাও ধারণ করেনা, তাই তারা এরকম ধারণা করতে পারে। এই যুগে হাফপ্যান্ট পরেও নিজেকে মুসলমান দাবি করা যায়, তাই তৎকালীন সময়ে মুসলমান সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য কতোটা শিক্ষাদীক্ষা ও আদব-কায়দার প্রয়োজন ছিল, সে সম্পর্কে বর্তমান মুসলমানদের কোন জ্ঞানই নেই। তাদের ধারণা, নিচুশ্রেণীর হিন্দুরা কলেমা পড়লেই বোধহয় সম্মানিত মুসলমান হয়ে যেত!

অথচ নওয়াব আবদুল লতিফ তার বইতে লিখেছিলেন, “সম্ভ্রান্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরা কখনোই তাদের সন্তানদের ফারসী-উর্দু শিক্ষা থেকে বিরত রাখার চিন্তাও করতে পারে না। কারণ প্রয়োজন মোতাবেক ফারসী-উর্দু লফয শিক্ষা না দিলে সন্তানের আদব-কায়দা পরিপূর্ণ হয়না।” মুসলিম আমলে ফারসী ভাষা ও আদব-কায়দা শিক্ষা করে তারপর হিন্দুরা মুসলিম শাসকদের গোলামি করতে পারত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছে-“নবাবী আমলে আদব-কায়দা করিতে করিতে কর্মচারীদিগের প্রাণান্ত হইতো...বর্তমান রাজ-মহাত্মারা সে বিষয়ে একেবারেই অভিমানশূন্য...কেহ যদি সেলাম না করে তাহাতে কিছুমাত্র ক্ষোভ নাই।”(সূত্র: আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, মুহম্মদ মনিরুজ্জামান, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ১৪০) প্রশ্ন হতে পারে, আদব-কায়দা করতে গিয়ে যদি হিন্দুদের প্রাণান্ত হয়, তবে মুসলমান সন্তানের আদব-কায়দা কতো বেশি শিক্ষা করতে হতো? আর এই ফারসী ভাষা ও আদব-কায়দা শিক্ষা করত উচুশ্রেণীর হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা, নিচুশ্রেণীর হিন্দুরা নয়।

নীরদ সি চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লিখেছে যে, উচুশ্রেণীর হিন্দুদের পোষাক আশাক মুসলমানদের মতোই ছিল, অর্থাৎ তারা ধুতি-নেংটি পরা হিন্দু ছিল না। ধুতি-নেংটি পরা হিন্দু ছিল নিচুশ্রেণীর হিন্দুরা তথা নমশূদ্ররা, যারা ফারসী ভাষা ও আদব কায়দা শিক্ষা করত না। নীরদ সি চৌধুরী তার বইতে লিখেছে, তাদের মুখে কখনোই ভদ্রভাষা শোনা যেত না, সবসময় গালিগালাজ করত। সম্প্রতি নওমুসলিম আবদুল আজিজ এ সম্পর্কে বেশকিছু স্ট্যাটাস দিয়েছেন, দেখিয়েছেন যে তাদের শূদ্রজাতি গালিগালাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। (https://goo.gl/qkCIsc)


অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা নয়, বরং এই নমশূদ্রগুলোই প্রকৃত হিন্দু, আর প্রকৃত হিন্দু হওয়ার কারণেই তারা সবচেয়ে অসম্মানিত ও ধিকৃত জাতি। এরা ফারসী ভাষা শিক্ষা করেনি, ইসলামী সংস্কৃতির কোনকিছু ধারণ করেনি। এরা কীভাবে দলে দলে মুসলমান হবে? যতোসব ফালতু কল্পকাহিনী এগুলো। অনেকের ধারণা, নিচুশ্রেণীর হিন্দুদের দলে দলে মুসলমান হওয়ার বর্ণনাটি বোধহয় ইতিহাস থেকে নেয়া হয়েছে। আসলে ইতিহাসে এরকম কোন বর্ণনাই নেই। এই কল্পকাহিনীর সূত্রপাত হয় ১৮৭০ সালের দিকে হার্বাট রিজলী নামক এক ইংরেজের দ্বারা। সে জেলখানায় কিছু মুসলিম কয়েদীর নাকের মাপ নিয়ে দাবি করে যে, নিচুশ্রেণীর হিন্দুদের সাথে তাদের নাকের মাপ মিলে যায়। তাই বাঙালি মুসলমান নিচুশ্রেণীর হিন্দুদের বংশধর। বলা বাহুল্য, আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারে এই বক্তব্যের বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই। এমনিতে ভারতবর্ষের যে প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থগুলি রয়েছে রিয়াজ উস সালাতীন, বাহরিস্তান ই গায়বীর ন্যায়, সেগুলোর তো সবই মুসলিম রচিত। সেখানে কোথাও এধরণের কোন কল্পকাহিনীর অস্তিত্ব নেই।

Post a Comment

 
Top