গতানুগতিক ইতিহাসে আমরা দেখে থাকি, মুসলমানদের যেই দোষ নেই সেই দোষও চাপিয়ে দেয়া হয়, আর হিন্দুর ক্ষেত্রে যদি কোন ত্রুটি থাকে তবে তাকে হাল্কা করে দেখা হয় এবং পারলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদী লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের কথাই ধরা যাক। পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়ে এসেছি, বঙ্কিমচন্দ্র নাকি ‘ডায়াবেটিস’ হয়ে মারা গিয়েছিল। অথচ শচীশ চট্টোপাধ্যায় (বঙ্কিমের ভাইয়ের ছেলে) রচিত বঙ্কিমের জীবনীতে তার মৃত্যুবস্থা নিয়ে নিম্নোক্ত বিবরণ রয়েছে- “বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর দুই তিন সপ্তাহ পূর্বে তাহার মূত্রনালীতে একটা স্ফোটক জন্মিয়াছিল। অস্ত্র-চিকিৎসাবিশারদ ওব্রায়েন আসিয়া বলিল, ‘স্ফোটকটি কালবিলম্ব না করিয়া অস্ত্রপচার করিতে হইবে।’ অন্যান্য চিকিৎসকেরা একমতাবলম্বী হইল। বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু ঘোরতর প্রতিবাদ করিল। সে বলিল, “অস্ত্রাঘাত হইলে বিষাক্ত পুঁজ রক্তের সহিত সংমিশ্রিত হইয়া যাইতে পারে-মিশিয়া গেলে রক্ত দূষিত হইয়া পড়িবে, তখন মৃত্যু অনিবার্য।’ দুই তিন দিন পর পুরাতন ক্ষতের পার্শ্বে আর একটি নতুন স্ফোটক দেখা দিলো। কয়েকটি দিন জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সংগ্রামে তাকে নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। ২৩ চৈত্র (৫ এপ্রিল) তারিখ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।...১৩০০ ফসলী সনের ২৬ চৈত্র, ১৮৯৪ এর ৮ এপ্রিল অপরাহ্নে, তিনটে বেজে পঁচিশ মিনিটের সময় স্বগৃহে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়।”

উপরের বর্ণনাটি পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৭৯৭ এ পাওয়া যাবে। এখানে প্রশ্ন হলো, ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ মূত্রনালীতে ‘বিষাক্ত পুঁজ’ ওয়ালা স্ফোটক বা ফোঁড়া হয়ে মারা যায়, নাকি সিফিলিস বা এজাতীয় রোগের কারণে? কিন্তু এই ইতিহাস তো কচি বয়সের মুসলমান শিক্ষার্থীদের শেখানো যাবে না, তাদেরকে ব্রেনওয়াশ করতে শেখাতে হবে যে ঐসব বেশ্যাখোর হিন্দুরা ছিল মহান! ঠিক সেভাবেই রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মণ কুলীন সন্তান বানানো হয়েছে, যদিও ইতিহাস অনুযায়ী তার পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী কলকাতার গোবিন্দপুরের নিন্মবর্ণের হিন্দুদের পাড়ায় বসবাস করত। ব্রিটিশরা জাহাজের মালপত্র উঠানোর কাজে যখন গোবিন্দপুরের নিন্মবর্ণের হিন্দুদের নিয়োগ দিল, তখন তাদের সর্দার হলো এই পঞ্চানন কুশারী। হিন্দুরা সর্দার বা প্রধানকে ডাকতে ‘ঠাকুর’ শব্দটি ব্যবহার করে, পঞ্চাননকেও তারা তাই ‘ঠাকুর’ বলে ডাকত। এভাবে ব্রাহ্মণ হিসেবে নয়, শ্রমিকসর্দার হিসেবে পঞ্চাননের নামের শেষে ‘ঠাকুর’ শব্দটি বসে গেল। ব্রিটিশরাও তাকে ডাকা শুরু করল ‘টেগোর’ নামে। কালক্রমে এই ‘ঠাকুর’ উপাধিই পঞ্চানন ও তার বংশধরেরা তাদের নামের শেষে লাগানো শুরু করে দেয়। গুগলে ‘পঞ্চানন কুশারী শ্রমিক’ এই তিনটি কী-ওয়ার্ড লিখে সার্চ দিলে ঘুরেফিরে এই একই ইতিহাস পাঠকেরা বিভিন্ন পত্রিকার বরাতে দেখতে পাবেন। (https://goo.gl/3R1QIO, https://goo.gl/izz5fN)

কিন্তু পত্রিকাগুলো এই ইতিহাস লিখেছে অনেক ভদ্রভাষায়, আর মুসলমানরাও ‘অছাম্প্রদায়িকতা’র কারণে কোন প্রশ্ন তুলে না। ডায়াবেটিসে ধোনে পুঁজ হয়ে মরে কিনা, এই প্রশ্ন করলেই কিন্তু বঙ্কিমের জারিজুরি ধরা পড়ে যায়। ঠিক সেভাবেই এই দুটি প্রশ্ন রইল রবীন্দ্রনাথের বাপদাদার উপরোক্ত ইতিহাস নিয়ে- ১) কোন ব্রাহ্মণ কী নিচুবর্ণের হিন্দুদের পাড়ায় বসবাস করতে পারে? কিছু কিছু পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, পঞ্চানন তার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিচুবর্ণের হিন্দুদের সাথে থাকা শুরু করে। কিন্তু পরিবার থেকে আলাদা হলেই কোন ব্রাহ্মণকে শূদ্রদের সাথে থাকতে হবে, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ২) কোন কুলীন ব্রাহ্মণ কী তার পদবী চেঞ্জ করতে পারে? করতে পারে না, বরং শূদ্ররা অনেক সময় এভিডেফিট করে ব্রাহ্মণ পদবী নেয়। ফেসবুকে একবার দেখেছিলাম, কলকাতার এক ‘মণ্ডল’ হিন্দু তার পদবী চেঞ্জ করে ‘চট্টোপাধ্যায়’ রেখেছে এবং পত্রিকায় তা প্রকাশ করেছে। ঠিক সেভাবেই রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ পঞ্চাননও নিজের ‘কুশারী’ পদবী বাদ দিয়ে গ্রহণ করেছিল ‘ঠাকুর’ পদবী। কেন করেছিল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Post a Comment

 
Top