গত কয়েকদিন ধরে আমি জনকণ্ঠে মুনতাসীর মামুনের ‘সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা’ নামে ধারাবাহিক কলামটি পাঠ করছি। প্রায়ই মনে হয়েছে, মুনতাসীর মামুন তার গতদিনের লেখায় যে ভুলটি স্বীকার করেছে, ঠিক তার পরেরদিনেই সেই একই ভুল করেছে। করতেই হবে, কারণ যেই ধর্মনিরপেক্ষতার গুড়াকৃমি সে এতোদিন ধরে পুষে এসেছে, তা তো একদিনে যাবে না।

মুনতাসীর মামুন গত ২০ই জুনে তার কলামের প্রথম পর্বে লিখেছিল-//আমরা কে হিন্দু বা মুসলমান ধর্মাবলম্বী সেটি কখনও মনে করিনি, অন্তত আমার মনে কখনও আসেনি। আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখছি, এখন আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে চিহ্নিত করছি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ হিসেবে। বাঙালী পরিচয়টি এখন গৌণ। আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ একটি পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। একটা পর্যায়ের পর ধর্ম বিষয়টি চলেই আসে। এটি অস্বীকার করতে পারেন গায়ের জোরে, কিন্তু এটিই বাস্তব// (সূত্র: http://goo.gl/786SuJ)

পাঠকেরা হয়তো জানেন, মুনতাসীর মামুনেরা কখনোই ধর্মকে (হিন্দু ধর্মকে নয়, ইসলাম ধর্মকে) এদেশের মানুষের পরিচিতি হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করেছে শুনলেই তাদের চুলকানি উঠে যেতো। সে হিসেবে এই স্বীকারোক্তিকে অনেকেই ধরে নিয়েছিল মুনতাসীর মামুনের ‘বোধোদয়’ হিসেবে।

কিন্তু এটি বোধোদয় নয়। পাছায় লাথি খেয়ে মানুষ হঠাৎ করে যেমন ক্যাৎ করে উঠে, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগের সাথে হিন্দুদের বিট্রেয়ালের ফলে মুনতাসীর মামুন সাময়িক ‘উহ’ করেছিল মাত্র। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জনকণ্ঠে আজ ২৫ তারিখে প্রকাশিত মুনতাসীর মামুনের কলামের শেষ পর্বে। সেখানে সে লিখেছে-//এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নও চলে আসে যা আগে উল্লেখ করেছি। ধর্ম যে জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না তার উদাহরণ পাকিস্তান (বাংলাদেশ)। ধর্মের অতিব্যবহারের ফলেই বাঙালী ১৯৭১ সালে তিতিবিরক্ত হয়ে শুধু যুদ্ধ নয়, সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করেছিল// (সূত্র: http://goo.gl/SV7ETn)

আসলে যেটা বলেছিলাম, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে। ধর্মীয় পরিচয়কে যে অস্বীকার করা যায় না, সেটাকে স্বীকার করেও ফের ঐ পাকিস্তানী জুজু দেখিয়ে ঘুরেফিরে ধর্মনিরপেক্ষতার পচা ধানই ভানবে মুনতাসীর মামুনেরা। এই মুনতাসীর মামুনদের সমস্ত চিন্তাভাবনা আচ্ছন্ন পাকিস্তান দিয়ে। এরা পাকিস্তান ছাড়া কিছু বোঝে না। পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে এরা গোটা দুনিয়াকে বিচার করতে চায়।
আজকে প্রত্যেকটি পত্রিকার মূল নিউজ ছিল, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে। কেন করেছে? কারণ তারা তাদের খ্রিস্টীয় স্বকীয়তা বজায় রাখতে চায়। এজন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাদের অভিনন্দন জানিয়েছে। ট্রাম্পের অভিনন্দনেই প্রমাণ করে যে, ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মই প্রাধান্য পেয়েছে, জাতি নয়।

খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গোঁড়ামির দাবিকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে পাউন্ডের দাম কমে গেল, শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নামলো, গোটা ইউরোপের কাঠামো উল্টে দেয়া হলো। তারপরও এই মুনতাসীর মামুনদের চোখে ধরা পড়ে না যে, ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব কতোটুকু। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এরা কমিউনিজমের আমলের মৃত তত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছে যে, ধর্ম নয়, বাঙালিত্বই আসল।
আচ্ছা এই বাঙালিত্ব জিনিসটা আসলে কী? খায়, না মাথায় দেয়?

এই কথাটা বললাম, কারণ কর্মসূত্রে কলকাতার বাঙালিদের সাথে মেশার সুযোগ আমার হয়েছে। এই রোযার কথা, আমি চট্টগ্রামের এক হোটেলে এক ক্যালকেশিয়ানের সাথে ডিনার করছি। সেখানে সেই ক্যালকেশিয়ান আমাকে তার মনের দুঃখগুলো বর্ণনা করছিল। কোন এক হোটেলে সে মদ খেতে যায়। কিন্তু রোযা উপলক্ষে সেখানেও মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি। তাই সে বার্টেন্ডারের কাছে মিনতি করছে, “দাদা গলাটা শুকিয়ে আসচে, দেন না একটু এক গ্লাস।”

ঐ ক্যালকেশিয়ানও বাঙালি, আমিও বাঙালি। কিন্তু সেটাই কি আমাদের চূড়ান্ত পরিচয়? আমার যেখানে শরবতের জন্য গলা শুকিয়ে আসে, সেখানে ঐ ক্যালকেশিয়ানের গলা শুকিয়ে আসে শরাবের জন্য। এই পার্থক্য কী স্রেফ ‘বাঙালিত্ব’ দিয়ে ঘুঁচিয়ে দেয়া সম্ভব? বাঙালিত্ব নয়, ধর্মই এক্ষেত্রে মূখ্য।

Post a Comment

 
Top