ব্রিটিশ আমলের শেষের দিককার কথা। কলকাতার বুকে মুসলিম পত্রপত্রিকাগুলো জোরালো ভাষায় মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম ছিলো শ্রী-পদ্ম। মুসলিম পরিচালিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রী-পদ্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলো, সাথে সাথে মুসলিম ছাত্র-তরুণদের মধ্যে দেখা দিলো বিক্ষোভ। মুসলমান যুবকেরা তাদের যুক্তি তুলে ধরলো, শ্রী হলো সরস্বতীর নাম ও পদ্ম হলো তার আসন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমানরাও পড়াশোনা করে, তাই এই হিন্দুয়ানী প্রতীক সেখানে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কর্তৃপক্ষ প্রথমে মুসলমানদের দাবি মেনে নিতে চায় নাই। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিম পত্রপত্রিকাগুলোর কাছে নতি স্বীকার করলো হিন্দুরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রী বাদ দেয়া হয়, পদ্মও রূপান্তর গ্রহণ করে।

অহীন্দ্র চৌধুরী ছিলো কলকাতার প্রথমসারির নাট্যকার। সে চাইলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসকে নাটক আকারে মঞ্চস্থ করতে। কিন্তু আনন্দমঠ ছিলো সাম্প্রদায়িক উপন্যাস, যাতে সরাসরি বলা হয়েছে ‘মসজিদ ভাঙিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব।’ মুসলমান পত্রপত্রিকাগুলোর প্রতিবাদে তার মুসলিমবিদ্বেষী নাটক ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে, এই ভয় পেয়ে অহীন্দ্র চৌধুরী ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’র সাংবাদিকদের চায়ের দাওয়াতে ডাকলো আলোচনার জন্য। সেখানে সে মুসলিমবিরোধী ‘বন্দেমাতরম’ গান বাদ দিয়ে ‘সন্তান’ নামে আনন্দমঠের সংশোধিত ভার্সন মঞ্চস্থ করার প্রস্তাব জানালো।

‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’র মুসলমান সাংবাদিকরা ‘বিষয়টি’ ভেবে দেখবেন বলে জানিয়ে বিদায় নেন। পরবর্তীতে অহীন্দ্র চৌধুরী ‘বন্দেমাতরম’ সহই আনন্দমঠ মঞ্চস্থ করে। সাথে সাথে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে এর প্রতিবাদ ছাপা হয়। তাতে করে উল্টো অহীন্দ্র চৌধুরী মিথ্যা দাবি করে, মোহাম্মদীর মুসলমান সাংবাদিকরা নাকি তাকে নাটক মঞ্চস্থ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। উত্তরে মোহাম্মদীর সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানিয়ে সত্যটি উন্মোচন করে আরেকটি সংবাদ তাদের পত্রিকায় ছাপেন। এর পরই মুসলিম যুবকেরা প্রতিবাদস্বরূপ কলকাতার গড়ের মাঠে প্রকাশ্যে ‘আনন্দমঠ’ এর কপিতে অগ্নিসংযোগ করে বঙ্কিমভক্তদের মুখে চুনকালি লেপে দেন।

উপরের ইতিহাস সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর বাঙালি মুসলমান সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ আত্মজীবনী থেকে নেয়া। (আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পর্কে জানতে: http://goo.gl/ADGA3o) চিন্তা করুন পাঠকেরা, সেই ব্রিটিশআমলে হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতার বুকে বসে মুসলমান সাংবাদিকেরা হিন্দুদেরকে বাধ্য করেছিল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে হিন্দুয়ানী ‘শ্রী’ অপসারণ করতে! এমনকি হিন্দুরা নাটক মঞ্চস্থ করতেও ভয় পেতো মুসলমান পত্রপত্রিকাগুলোর কারণে।

বিপরীতে এই স্বাধীন বাংলাদেশে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে সভা সেমিনার করলেও কোন প্রতিবাদ হয়না।  যখন ব্রিটিশ আমলে কলকাতার বুকে বাঙালি মুসলমান সাংবাদিকদের দাপটের ইতিহাস পড়ি, তখন এই একবিংশ শতাব্দীতে ঢাকা শহরে বসেও নিজেকে আর স্বাধীন দেশের বাসিন্দা বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনা। কলকাতার বুকে সংগ্রাম করে সাতচল্লিশে যেই মানচিত্র আমরা পেলাম, আজ তারই রাজধানী ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় কিনা মসজিদ নির্মাণ বন্ধ করে দেয় ঐক্য পরিষদের মতো একটি বস্তিমার্কা সংগঠন!

ইসলামবিরোধী কথিত সুশীল, রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে ফুটপাতের হিন্দু মুচিটাও এখন চাইলেই ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করতে পারে। কারণ বর্তমানে মুসলমানদের পক্ষে বলার একটি পত্রিকাও দেখা যায় না, বিপরীতে ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের পত্রিকা থাকার কারণে কলকাতার বুকেও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। মিডিয়াই মানে স্বাধীনতা, বলতে পারাটাই হলো স্বাধীনতা। তখন মুসলমানরা বলতো দেখেই কলকাতায় থেকেও তারা ছিল স্বাধীন, আর আজকে মুসলমানরা বলে না দেখেই স্বাধীন বাংলাদেশে বসেও তারা পরাধীন।

Post a Comment

 
Top