“সিদ্ধার্থ শংকর রায় যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিল তখন কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় লেগে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা থামাবার অনুরোধ পৌঁছালো স্বাভাবিকভাবেই। আমাদের মনে হয়, দাঙ্গা বৃদ্ধিকরণের মূলে থাকে হিন্দু পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ। তাই সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিলো, পার্কসার্কাস এলাকায় একজন মুসলমান ওসি নিয়োগ করতে। তখন পুলিশ কমিশনার জানালো, কলকাতার কোনো থানাতেই নেই কোনো মুসলিম ওসি। সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কঠোরভাবে নির্দেশ দিলো, তাড়াতাড়ি এমন ব্যবস্থা করতে যাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি থানায় কিছু কিছু মুসলিম পুলিশ অফিসার ও মুসলিম কনস্টেবল নিয়োগ করা হয়। তারপর থেকেই সারা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে পুলিশ বিভাগে অফিসার ও কনস্টেবল পদে চাকরি দেয়া হলো বহু মুসলমান যুবককে। সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পর বামফ্রন্টের আগমন ঘটলো। তারপর থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা কম হওয়ার বা দাঙ্গা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে থানায় কর্মরত মুসলিম পুলিশ স্টাফদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।”

ভারতীয় ইতিহাসবিদ গোলাম আহমাদ মোর্তজা তাঁর রচিত ‘ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়’ বইটির ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বইটির বরাতে উপরের ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি শুনেই বোঝা যায় যে, কেন ভারতের মুসলিম নেতা আকবরউদ্দীন ওয়াইসি বলেছেন “ময়দান থেকে পুলিশ সরিয়ে নিলে ভারতের মুসলমানরা ভারত দখল করে নিবে।”

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের জন্ম থেকে শুরু করে আজ অবধি যতগুলো দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই মূল ভূমিকা পালন করেছে সেদেশের পুলিশ বাহিনীর হিন্দু সদস্যরা। শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা হলো-

৪৭ এর দিল্লী দাঙ্গা: “দিল্লীতে যা ঘটে তার পিছনে শহরের তাবৎ হিন্দু ও শিখ জনসাধারণের নৈতিক সম্মতি ছিল আর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নৈতিক সম্মতিরও বেশি কিছু ছিল (অর্থাৎ সক্রিয় সহযোগিতা ছিল) এসব ঘটনা ঘটার পেছনে। হিন্দুরা মুসলমানদের সবজিমণ্ডি, পাহাড়গঞ্জ ও করোলবাগের মতো সেইসব এলাকা বিশেষভাবে খতম করলো, যেখানে মুসলমানরা ছিল একান্তভাবে সংখ্যাগুরু।...সবজিমণ্ডি দাঙ্গার শেষ পরিণতি হলো-তিন চারদিন পর ঐ অঞ্চলে একজন মুসলমানের চিহ্ন রইল না। রাস্তাগুলির পাশে একেবারে শব্দার্থে সারি সারি মৃতদেহ পড়ে থাকতো এবং নালাগুলির প্রবাহ মৃতদেহের জন্য একেবারে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ দাঙ্গায় হিন্দুরাই সর্বাগ্রে মুসলমানদের বাড়ি লুট করার পর পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর ঘটনাস্থলে আবির্ভাব ঘটে এবং হিন্দু, শিখ ও হিন্দু পুলিশ ও সেনাবাহিনীরা মিলিতভাবে মুসলমানদের দিল্লী থেকে উৎখাত করে।” 

জামশেদপুর দাঙ্গা: “জামশেদপুর ভারতের প্রখ্যাত শিল্পাঞ্চল। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। ... পুলিশ দাঙ্গা থামাবে কী? উল্টো তাদের একটি বড় অংশ দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলিম নিধন, পীড়ন ও তাদের ধনসম্পত্তি বরবাদের কাজে মত্ত হয়ে উঠলো। দাঙ্গায় নানা রকম নিষ্ঠুর ঘটনার মধ্যে পুলিশ ও হিন্দু কর্তৃক একটি অমানুষিক ঘটনাও ঘটে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ৬০ জন মুসলমান নরনারী ও শিশুকে দু’জন সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মাঝপথে অ্যাম্বুলেন্সের আদিবাসী হিন্দু চালক ইচ্ছা করে গাড়িটি সদর রাস্তা ছেড়ে এক গলিতে প্রবেশ করে। সেখানে উক্ত দু’জন পুলিশের পরিকল্পনা ও প্রশ্রয়ে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা হিন্দুরা অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সেখানে থাকা মুসলিম নারী ও শিশুরা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।”

ভারতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে একটি ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল; যা ‘মোরাদাবাদ দাঙ্গা’ নামে পরিচিত। ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থের ১০৪-১০৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে যে, “১৯৮০ সালের ১৩ই আগস্ট ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। অল্প উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিশাল ঈদগাহ ময়দানে নামাযে যোগ দিয়েছিলেন ৫০ হাজার মুসলমান, সাথে অনেক শিশু। নামাযের মাঝখানে পাহারারত পুলিশদের যোগসাজশে একটি শূকর ছেড়ে দেয়া হলো নামাযরত মুছল্লীদের মাঝে।
স্বাভাবিকভাবেই মুছল্লীদের সাথে নামায শেষে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়। এ সুযোগটিরই অপেক্ষায় ছিল হিন্দু পুলিশেরা। তারা মুছল্লীদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। একতরফা গুলিবর্ষণে হাজার হাজার মুসলমান ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।”

সম্প্রতি বাংলাদেশের পুলিশবাহিনীর মাঝেও আমরা দেখতে পাই সেই মুসলিম নিধনকারী ভারতীয় পুলিশেরই ছায়া। হিন্দুদের মধ্যে লাঠি বিতরণ, পিটিয়ে মেরে ফেলার আহবান, হিন্দুদের কথায় গেণ্ডারিয়ায় মসজিদ নির্মাণ বন্ধ করে দেয়া সবকিছুর পেছনেই রয়েছে দাঙ্গা সৃষ্টির স্পষ্ট উদ্দেশ্য।

কারণ ভারতের ন্যায় এখন এদেশেও দাঙ্গা করলে পুলিশ সদস্যরা পাবে ভালো পোস্টিং, প্রমোশন, সুযোগসুবিধা। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় যে পুলিশ যতোবেশি দাঙ্গা করতে পেরেছে, তার ততো ভালো পোস্টিং হয়েছে। আর যে পুলিশ দাঙ্গা করতে বাধা দিয়েছে, তাকে করা হয়েছে সাসপেন্ড। আমরা জানি যে, বর্তমানে এদেশেও সরকারি চাকরিতে প্রমোশন নিশ্চিত করা হয় ভারতীয় দূতাবাস থেকে। তাই অদৃশ্য হাতের ইশারায় এদেশেও পুলিশ সদস্যরা দাঙ্গা করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

Post a Comment

 
Top